মোমিন ও কাফেরের দৃষ্টিতে দুনিয়া
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন : ‘দুনিয়া মোমিনের জন্য কয়েদখানা আর কাফেরের জন্য স্বর্গ’- মুসলিম শরিফ।
গ্রন্থ পরিচিতি : সহীহ মুসলিম শরিফ হাদিস বিষয়ক প্রধান ছয়টি (সিহাহ সিত্তাহ্) গ্রন্থের দ্বিতীয়। বুখারি শরিফের পরেই এর স্থান। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ ২০৪ হিজরি খোরাসান প্রদেশের নিশাপুরে (ইরান) জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬১ হিজরির ২৬ রজবে ইন্তেকাল করেন। তিনি ইমাম বুখারির (রহ)-এর শাগরিদ ছিলেন। মুসলিম শরিফ সংকলনটি করতে তাঁর দীর্ঘ ১৫টি বছর লেগেছিল। এতে পুনরুক্তসহ প্রায় ১২ হাজার হাদিস রয়েছে। পুনরুক্ত বাদ দিলে হাদিসের সংখ্যা প্রায় ৪০০০। ইমাম মুসলিম তাঁর মুখস্থ তিন লক্ষাধিক হাদিস থেকে বাছাই করে এই বিশুদ্ধ হাদিস সংকলনটি তৈরি করেন।
বর্ণনাকারীর (রাবি) পরিচিতি : প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা. এই হাদিসটির বর্ণনাকারী। তাঁর নাম ছিল আব্দুস শামস এবং ইসলাম গ্রহণের পরে তাঁর নাম রাখা হয় আব্দুর রহমান। তিনি বিড়াল ছানাকে খুব পছন্দ করতেন বিধায় রসুলুল্লাহ সা. তাঁকে আবু হুরায়রা তথা বিড়াল ছানার মালিক বা পিতা উপনামে ডাকতেন এবং এই উপনামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ৭ম হিজরিতে মদিনায় খায়বর যুদ্ধের প্রাক্কালে ইসলাম গ্রহণ করেন। সে-সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০ বছর। ইসলাম গ্রহণের সময়ে তাঁর মা জীবিত ছিলেন এবং সে-সময়ে তাঁর মা পৌত্তলিকতার উপর অটল ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলে মা তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। রসুলুল্লাহ সা.-কে মা’র জন্য দোয়া করতে বললে তিনি দোয়া করেন। শেষে তাঁর মা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসেন।
সাহাবিদের মাঝে তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৫৩৭৫। ইমাম বুখারির মতে আট শতাধিক রাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেন। এ কারণে তাঁকে রাবিদের নেতা বলা হয়। তিনি আসহাবে সুফ্ফার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ৫৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।
হাদিসটির ব্যাখ্যা :
এই হাদিসটি বহুল প্রচলিত। কারো দু:খ-কষ্ট, বিপদ-মুসিবত দেখা দিলেই আমরা এই হাদিসটি আউড়ে তাৎক্ষণিক বলে থাকি, দুনিয়া মোমিনের জন্য নয়। এখানে রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা- যন্ত্রণা সব মোমিনের প্রাপ্য এবং দুনিয়া হলো কাফেরের। অথচ যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে আল্লাহ তাদেরকে উত্তম রিজিক ও সুন্দর জীবন -যাপন এবং দুনিয়ায় খেলাফত দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন’- সুরা নুর ৫৫।
হিজরতের প্রাক্কালে আল্লাহপাক তাঁর নবিকে দোয়া শিখিয়ে দেন- ‘হে আমার পরোয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি সার্বভৌম শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও’- সুরা বনি ইসরাইল ৮০-৮১।
আবার সুরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহপাক ইমানদারদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্যই মুহাম্মদ সা.-এর উম্মতের উত্থান এবং এদের কাজ হলো সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা। আদেশ দান তারাই করতে পারে সমাজে যাদের কর্তৃত্ব থাকে। এতে বোঝা যায়, আল্লাহর যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষ থেকে দুনিয়াকে শাসন করার জন্য তিনি মোমিনদের সাহায্য করতে চান। এমনটিই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে দুনিয়াটা মোমিনদের জন্য জিল্লতির জীবন কেন হবে? যদি হয় সেটি তাদের দায়িত্ব অবহেলা এবং মোমিনসুলভ গুণাবলি ও যোগ্যতার অভাবে।
আজ থেকে প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে আমি বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের যুগ্ম-সম্পাদক মাওলানা মীম ফজলুর রহমান (মরহুম)-এর নিকট থেকে এই হাদিসটির দরসে ভিন্নতর ব্যাখ্যা শুনেছিলাম। আমার অন্তরে সেটা এখনও গেঁথে আছে। আমি সেটাই এখানে উল্লেখ করবো।
তিনি আলোচনায় বলেছিলেন, রসুল সা.-এর শব্দচয়নটা আমাদের বুঝতে হবে। জান্নাতের বিপরীত শব্দ হলো জাহান্নাম (যা দু:খ-কষ্ট ও শাস্তিভোগের স্থান)। রসুল সা. মোমিনের জীবনকে জাহান্নামের সাথে তুলনা করেননি, করেছেন কারাগারের সাথে। এবারে আমরা ব্যাখ্যায় আসি।
দুনিয়াটা মোমিনের জন্য কারাগার।
১. কারাগারের জীবন একটা নির্দিষ্ট নিয়ম- শৃঙ্খলার বেড়াজালে আবদ্ধ। কারাবিধি অনুসারে তাকে চলতে হয়। মোমিনকেও আল্লাহর দেয়া নিয়ম-কানুন অনুসারে এ দুনিয়ার জীবনটা পরিচালনা করতে হয়। সে এখানে বল্গাহীন ও একেবারে স্বাধীন নয়। হালাল-হারামের বিধি- বিধানের আওতায় তাকে জীবনযাপন করতে হয়।২. কারাগারের জীবন একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। মেয়াদ পূর্তির আগে সে কারাগার থেকে বের হতে পারে না, আবার মেয়াদ পূর্তির পরে কেউ তাকে আটকিয়েও রাখতে পারে না। মোমিন বিশ্বাস করে যে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে (হায়াত) সে এ দুনিয়াতে এসেছে। মেয়াদ পূর্ণ না হলে হাজারো চেষ্টা করেও কেউ থাকে এ দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে পারে না; আবার মেয়াদ পূর্ণ হলে এ দুনিয়ায় কেউ তাকে ধরে রাখতেও পারবে না। এ বিশ্বাস পোষণের কারণে মোমিন হয় সাহসী।
৩. একজন ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সে কারাগারকে আপন করে নেয় না বরং সে প্রহর গুণে, কবে তার মেয়াদ পূর্ণ হবে এবং আপনজনের কাছে ফিরে যাবে। ঠিক তেমনি এ দুনিয়াটা মোমিনের আসল ঠিকানা নয়। তার জন্য অসংখ্য নেয়ামতেভরা জান্নাত আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং আল্লাহ হলেন মোমিনের সর্বোত্তম অভিভাবক ও সবচেয়ে কল্যাণকামী। মোমিন জান্নাতের প্রত্যাশী। কিন্তু এ জান্নাত দুনিয়ায় নয়, মৃত্যুর পরেই সম্ভব। তাই মোমিন মৃত্যুভয়ে ভীত নয়- আখেরাতে জবাবদিহির ভয়ে ভীত। দুনিয়ার এ জীবনটা সে আপন করে নেয় না, বরং সব সময় সে অগ্রাধিকার প্রদান করে আখেরাতকে। মৃত্যু তাকে রোগ-শোক-দু:খ-কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে তার রবের সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাব)। এই ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মোমিনের কোনো ভয়-ভীতি বা ওজর-আপত্তি নেই। মা’র কাছে সন্তানের যাওয়া যেমন খুবই কাঙ্ক্ষিত, তেমনি আল্লাহর কাছে একজন মোমিনের ফিরে যাওয়াটা তার চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত।
পক্ষান্তরে কাফেরের জন্য দুনিয়াটা জান্নাত সদৃশ।
১. জান্নাত হলো ফলভোগের জায়গা এবং সেখানে মানুষ যা চাবে তাই পাবে, যা ইচ্ছা করবে সেটাই হবে। এ-প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য বেহেশতে তাই হবে, যা তোমাদের মন পেতে ইচ্ছা করবে এবং সেখানে তাই লাভ করতে পারবে যা তোমরা পেতে চাইবে’- সুরা হামিম আস সাজদাহ ৩১। একজন কাফের দুনিয়ায় জান্নাতের সুখ অর্থাৎ বল্গাহীন জীবনযাপন করে। তাকে একদিন এ দুনিয়া ত্যাগ করে যেতে হবে এবং কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে- এ উপলব্ধি তার নেই। সে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন সত্ত্বার অধিকারী মনে করে। তাই সে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার ধার ধারে না বা হালাল-হারামের বাছ-বিচার করে না।
২. জান্নাতে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। আল্লাহ বলেন, ‘সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং কখনো সে স্থান থেকে অন্য কোথাও যেতে চাইবে না’- সুরা কাহফ ১০৮। কাফের এ দুনিয়ার জীবনটাকেই জান্নাতের মতো স্থায়ী মনে করে। প্রতিনিয়ত সে মৃত্যু দেখে এবং একদিন তাকেও যে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এ উপলব্ধি তার নেই। ফলে দুনিয়ায় একজন মুসাফির হিসেবে নয় বরং স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবেই সে বসবাস করে এবং সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। এ সম্পদ তাকে চিরন্তন জীবন দান করবে- এমনই তার ভাবনা (আল্লাহ তায়ালা সুরা তাকাসুরে তা উল্লেখ করেছেন)।
৩. কাফের যেহেতু পরকাল বিশ্বাস করে না তাই সে দুনিয়ার জীবনটাকেই আপন করে নেয়। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য সে পাগলপ্রাণ হয়ে ছুটে। দুনিয়ায় নাম-যশ-খ্যাতির স্বার্থে সে তার প্রতিপক্ষকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া বা মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতনে একটুও পিছপা হয় না। দুনিয়াটা যেন তারই- এমন ভাবনা-চিন্তা তাকে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারে পরিণত করে।
শিক্ষা : রসুলুল্লাহ সা. চমৎকারভাবে মোমিন ও কাফেরের জীবনের তুলনা করেছেন। মোমিনের চলাফেরা ও জীবনযাপনে স্বেচ্ছাচারিতার লেশমাত্র নেই। কারণ সে মৃত্যুর পর আখেরাতের জীবনকে বিশ্বাস করে। সে জানে, আল্লাহর বিধান মতো চলতে পারলেই আখেরাতের চিরস্থায়ী জান্নাতে তার ঠিকানা হবে। ফলে সে নিজেকে স্বাধীন মনে না করে আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা হয়ে চলার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে কাফের আখেরাতকে বিশ্বাস করে না এবং তার কাছে হালাল-হারাম ও ন্যায়-অন্যায়ের কোনো উপলব্ধি নেই। সে হয় স্বেচ্ছাচার, মন যা চায় তাই করে। তার থেকে দুনিয়াবাসীও কোনো কল্যাণ পায় না। বরং জুলুম-নির্যাতনেরই শিকার। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর অনুগত বান্দা হয়ে চলার তৌফিক দান করুন।
লেখক,প্রফেসর তোহুর আহমেদ হেলালী
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.