সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

মাজহাবগত ভিন্নতা ও বিদয়াত এক নয়

মাজহাবগত ভিন্নতা ও বিদয়াত এক নয়

মাজহাবগত ভিন্নতা ও বিদয়াত এক নয়

রসুলুল্লাহ সা.-এর আমল সবসময় একরূপ ছিল না, ভিন্নতার কারণেই বিভিন্ন মাজহাবের উদ্ভব হয়েছে। উদ্দেশ্য, দীন পালনে সহজতা দান। মত- পার্থক্যগত বিষয়ে যে কোনো মত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। সকল ইমামই সত্যপন্থী এবং আহলে হাদিস হিসেবে যারা নিজেদের পরিচয় দেন তাঁরাও সত্যপন্থী। এই ভিন্নতার সাথে বিদয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই।

আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর আনুগত্যের নামই ইবাদত। ইবাদতের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ল এবং অনুসরণ করতে হবে রসুলুল্লাহ সা.-এর।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের আমল বিনষ্ট করো না’- মুহাম্মদ ৩৯।
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা গ্রহণ করো ঐ জিনিস যা রসুল তোমাদের দিয়েছেন এবং বর্জন করো যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন’- হাশর ৭।

একজন মুমিনকে সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর অনুগামী হয়ে চলতে হবে, কখনো অগ্রগামী হয়ে নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী,
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না’- সুরা হুজুরাত ১।
অর্থাৎ এ অধিকার নেই যে, সে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে নিজের থেকে বরং প্রথমেই তালাশ করবে আল্লাহর বিধান এবং তারপরে রসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ।
রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন (আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত), ‘যে ব্যক্তি দীনে এমন কিছু আমদানি করলো যা দীনের অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত’- বুখারি ২৬৯৭।
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করলো যাতে আমার আদেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত’- মুসলিম।

ইসলামী শরীয়তে বিদয়াত বলতে বুঝায় এমন আমলকে যা নব আবিষ্কার অর্থাৎ নেকির উদ্দেশ্যে এমন কিছু কাজ আমদানি করা, শরীয়তে যার ভিত্তি নেই। যা রসুলল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম পালন করেননি এবং চার ইমামের কোনো ইমামও অনুমোদন দেননি। সবই পরবর্তী সময়ে উদ্ভাবন।
শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করে তার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যেতে চায়। শয়তান ধর্মপ্রাণ মানুষকে মূর্তিপূজা, চুরি, ডাকাতি, জেনা- ব্যাভিচারে লিপ্ত করাতে পারে না। তাই সে নেকির ছদ্মবেশে বিদয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর নাফরমানি করায়। আর বিদয়াতিরা বুঝতেও পারে না, তাদের জীবনে কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে কারণ তারা তো সওয়াবের নিয়তেই কাজগুলো করে থাকে। এ যেন একটি চকচকে জাল টাকা যাতে সরকারের কোনো অনুমোদন নেই; ধরা পড়লেই ঠিকানা হবে জেলখানায়।

কোনো আমল শুধু এ কারণেই মূল্যহীন যেহেতু তা রসুল সা. ও তাঁর সাহাবিদের অনুমোদন নেই। মু’মিন সন্দেহজনক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। ফরজ ও ওয়াজিবে কোনো নতুনত্ব নেই, বিদয়াত কেবল মুস্তাহাব আমলের ক্ষেত্রে যা না করলে কোনো গুনাহ নেই। কিন্তু বিদয়াতিরা জিদ ধরে তার ওপর অনড় হয়ে থাকে। তারা ফরজ- ওয়াজিব ছাড়তে রাজি কিন্তু বিদয়াত ছাড়তে রাজি নয়। ইমাম সাহেবরাও তাদের ভয়ে অনেক সময় প্রকৃত সত্য বলতে সাহস পায় না। অথচ বিদয়াত সম্পর্কে রসুল সা. বলেছেন, ‘দীনের নামে সকল প্রকার নতুন কাজ থেকে তোমরা বিরত থাকো, কারণ দীনের নামে সকল নতুন কাজ বিদয়াত, আর প্রতিটি বিদয়াত ভ্রষ্টতা’- আবু দাউদ, তিরমিযী।

বিদয়াতের পরিণতি জাহান্নাম এবং হাশরের ময়দানে তারা রসুল সা.-এর কাছেও যেতে পারবে না ও হাউজে কাওসারের পানি পান থেকে বঞ্চিত হবে। মানুষ যাতে সহজভাবে ইসলাম পালন করতে পারে সেজন্য সম্মানিত ইমামগণ বিভিন্নভাবে মতামত দিয়েছেন যাতে বিদয়াতের কোনো চিহ্ন নেই বরং তাঁরা সবাই বলে গেছেন তাঁদের মতের বাইরে যদি কোনো হাদিস পাওয়া যায় তবে তাঁদের মত অগ্রাহ্য হবে। এ প্রসঙ্গে ইমামদের বক্তব্য নিম্নরূপ:
ইমাম আবু হানিফা র. (জন্ম ৮০ হিজরি) বলেন, -‘হাদিস সহিহ প্রমাণিত হলে সেটা আমার মাজহাব’- (শায়খ সালেহ আল-ফালানি, ইকাযুল হিমান পৃ ৬২)। তিনি আরো বলেন, ‘আমি যদি এমন কথা বলি যা আল্লাহর কিতাব এবং রসুল সা.-এর সুন্নাতের বিপরীত তাহলে তোমরা আমার কথা বর্জন করো’- (শায়খ সালেহ আল-ফালানি, ইকাযুল হিমান)।

ইমাম মালেক র. (জন্ম ৯৩ হিজরি) বলেন, ‘নবি করিম সা. ব্যতীত এমন কেউ নেই যার কথা গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় নয়। অর্থাৎ দীনের ক্ষেত্রে নবি করিম সা. ব্যতীত কেউ ভুলের উর্দ্ধে নয়’- (ইবনে আব্দুল হাদী, ইরশাদুল সালেক, ১ম খণ্ড পৃ ২২৭)।

ইমাম শাফেয়ী র. (জন্ম ১৫০ হিজরি) বলেন, ‘সব মুসলমান একমত পোষণ করেছে, যে ব্যক্তির নিকট রসুল সা.-এর সুন্নাত প্রকাশিত হবে তার জন্য বৈধ নয়, সেটা অন্য কারো কথার জন্য বর্জন করবে’- ইবনুল কাইয়্যিম ৩৬১, আল ফালানি ৬৮।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল র. (জন্ম ১৬৪ হিজরি) বলেন, ‘আমার তাকলিদ (অন্ধানুকরণ) করো না, ইমাম মালেক, শাফেয়ী, আওযায়ী এবং সাকরীর তাকলীদ করো না (দীনের বিধান) সেখান থেকে গ্রহণ করো যেখান থেকে তাঁরা গ্রহণ করেছেন’- আল ফালানি ১১৪ পৃ:, ইবনুল কাইয়্যিম, আল ইলাম, ২য় খণ্ড ৩০২।বিদয়াত সুন্নাতকে লোপ করে। ফরজ নামাজের পরে আস্তাগফিরুল্লাহ, আয়াতুল কুরসি পাঠ, সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর উচ্চারণসহ বিভিন্ন দোয়া দরুদ পাঠ হাদিস থেকে প্রমাণিত। অথচ সালাম ফেরানোর পর নিয়মিত মোনাজাতের ফলে হাদিস সমর্থিত এসব আমল করা হয়ে উঠে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য গ্রহণ করো।আমরা সবাই জানি তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে নামাজ শুরু ও সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়ে নামাজ সমাপ্ত হয়। নামাজের মধ্যে শেষ বৈঠকে রসুলুল্লাহ সা. নানা দোয়া শিখিয়েছেন। দোয়া মাছুরা রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক আবু বকর রা.-কে শেখানো দোয়া। দুই সেজদার মাঝে দোয়া এবং সেজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। হাদিসের ভাষায়, বান্দা যখন সেজদায় যায় তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে যায়। সুন্নাত ও নফল নামাজে আল্লাহ তায়ালার কাছে এসময়ে সবকিছু পেশ করা যায়।

আমি গত দুদিন বুখারি শরীফ ও ফিকহুস সুন্নাহ গভীর মনোযোগ সহকারে পড়লাম। নামাজ শেষে রসুল সা. কত সুন্দর দোয়া শিখিয়েছেন। মোনাজাতের অনুকূলে একটি বর্ণনাও চোখে পড়লো না। বরং পেলাম মোনাজাত না করার দলিল। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি করিম সা. বৃষ্টির জন্য ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে দোয়ার মধ্যে তাঁর হাত উঠাতেন না। আর তিনি হাত এতদূর উঠাতেন যে, বগলের শ্বেত অংশ দৃষ্ট হতো। বুখারি ৯৬৮।

অধিকাংশ মসজিদে সালাম ফেরানোর পরপরই মোনাজাত হওয়ার কারণে সুন্নাহ সমর্থিত দোয়া পড়া হয়ে ওঠে না। এই মোনাজাত সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন। ড. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এক আলোচনায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, রসুলুল্লাহ সা. জীবনে একটি বারের জন্যও ফরজ নামাজ শেষে আমাদের মতো হাত তুলে মোনাজাত করেননি।

কাবা শরীফে চার মাজহাবের ইমাম জামায়াতে নামাজ পড়িয়ে থাকেন। কোনো ইমামই আমাদের  মতো মোনাজাত করেন না। ২০১২ সনে হজ করার পর আমি মোনাজাত ছেড়ে দিয়েছি। ইমাম সাহেব জানেন না, বিষয়টি এমন নয়। আমার জানামতে মুসল্লিদের বিরূপ আচরণের ভয়ে অধিকাংশ ইমাম মোনাজাত ছাড়তে পারে না। কিছু আছে জেদের কারণে করে থাকেন। ঢাকা শহরে অনেক মসজিদে বর্তমানে সামষ্টিক মোনাজাত হয় না। ক্রমান্বয়ে বন্ধ হওয়ায় ভালো। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কোনো বিষয় বিদয়াত হলেও রাতারাতি দূর হওয়া সম্ভব নয়। ইনশা- আল্লাহ অনেক বিদয়াতের সাথে এটাও দূর হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিরক ও বিদয়াত থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন।

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

Comments are closed.

Verified by MonsterInsights