
শেষ পর্ব: এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের যে ছয়টি হক
দারসুল হাদিস - এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ছয়টি হক
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ
يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ
وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ” . قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
অর্থ: আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক হল ছয়টি। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে, মারা গেলে তার জানাযায় হাযির হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দিবে, যখন সাক্ষাৎ হবে তখন তাকে সালাম বিনিময় করবে, হাঁচি দিলে তার জওয়াবে দু’আ করবে এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত সকল সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। ( সূনান আত তিরমিজী: ২৭৩৭, মান-সহীহ)
শেষ পর্ব
وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ
অর্থাৎ একজন অপর মুমিনের উপস্থিতে বা তার অনুপস্থিতে তার কল্যাণ কামনা করবে। অন্য হাদীসে রসূল (স.) সকল মুসলমানদের জন্য কল্যাণকামিতাকেই দ্বীন বলেছেন।
মুমিনের জন্য কল্যাণ কামনা করা নবীদের বৈশিষ্ট:
কুরআন নূহ আলাইহিস সালাম-এর কথা উল্লেখ করেছে এভাবে,
وَأَنصَحُ لَكُمۡ
অর্থাৎ (নূহ বলল) আমি তোমাদের জন্য হিতকামনা করছি। [সূরা আ‘রাফ ৬২ আয়াত]
হূদ আলাইহিস সালাম-একই ভাবে তার জাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন,
وَأَنَا۠ لَكُمۡ نَاصِحٌ أَمِينٌ
অর্থাৎ “(হূদ বলল) আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্ক্ষী।” [সূরা আ‘রাফ ৬৮ আয়াত)
আলোচ্য হাদীসে এক মুমিন অপর মুমিনের দুটি অবস্থায় কল্যাণ কামনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত: যখন সে অনুপস্থিত:
অর্থাৎ একজন তার অপর মুমিন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতেও তার কল্যাণ কামনার অর্থ হলো-
১. তার অনুপস্থিতিতে তার কোন সম্পদ নষ্টতো করবেই না বরং সে যদি তা নষ্ট হতে দেখে তাহলেও সে তার হেফাজত করবে। কারণ মানুষ মাত্রই এই কামনা করে যে, তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ কেউ নষ্ট করবে না। রাসূল বলেন,
لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। [সহীহ বুখারী, ইফা: ১২]
সুতরাং সে নিজের জন্য যা কামনা করে তার অপর মুমিন ভাইয়ের জন্যও তাই কামনা করবে। তাই সে তার মুমিন ভাইয়েরে অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ-সম্মান নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করবে না এবং করতেও দিবে না।
২. তার অনুপস্থিতিতে তার সম্মান নষ্ট হয় এমন কোন কথা বলবে না। যেমন: কোন মুমিনের অনুপস্থিতিতে তার গীবত করা। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবেয় বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। [সূরা হুজুরাত : ১২]
এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কল্যাণকামী মুমিন তার অপর ভাইয়ের কখনো সমালোচনা করতে পারে না।
৩. অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র তার ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে না, বরং তার জন্য কল্যাণকর কার্য সম্পাদন করবে এবং তার জন্য ভালোবাসা লালন করবে। কারণ ঈমানের অঙ্গ। হাদীসে এসেছে,
لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। [সহীহ বুখারী, ইফা: ১২]
অর্থাৎ একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের প্রতি এমন হবেনা যে, সে তার সামনে খুব তোষামোদী করবে এবং পিছনে তার গীবত করবে, তার ক্ষতি সাধনে তৎপর থাকবে। কারণ এগুলোতো মুনাফেকদেরেই বৈশিষ্ট।
দ্বিতীয়ত: যখন সে উপস্থিত
একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের উপস্থিতিতে তার কল্যাণ কামনার অর্থ হলো যে, তাকে সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করবে, তার ভাইয়ের প্রতি সে যুলুম করবে না এবং তাকে যুলুম করতেও দিবে না। হাদীসে রাসূল (স.) এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেন,
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا ”. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذَا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا، فَكَيْفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا قَالَ ” تَأْخُذُ فَوْقَ يَدَيْهِ
অর্থ : তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক অথবা মাজলুম। তিনি (আনাস) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মাজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালিমকে কি করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে (অর্থাৎ তাকে যুলুম করতে দিবে না)। [সহীহ বুখারী, ইফা: ২২২৮]
এই ছাড়াও যদি মুমিনদের পরস্পরের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হয় তা মীমাংসা করে দিবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই, কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। [সূরা হুজুরাত: ১০]
উল্লেখিত হাদীসের অংশের আলোকে একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের আরো কিছু অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখবে এবং তার কল্যাণকামী হবে। যেমন:
১. সে তার ভাইকে ধোকা দিবে না এবং কোথাও কোন কারণে ধোকায় পড়ার আশংকা থাকলে সে তার ভাইকে সচেতন করবে। রাসূল (স.) বলেন,
وَمَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
অর্থ : আর যে ব্যক্তি আমাদের ধোকা দিবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। [সহীহ মুসলিম, ইফা: ১৮৫]
২. ক্রেতা বা বিক্রেতাকে ঠকানোর জন্য দালালী করবে না। যেমন রাসূল (স.) বলেন,
لاَ تَنَاجَشُوا وَلاَ يَبِعِ الْمَرْءُ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ وَلاَ يَبِعْ حَاضِرٌ لِبَادٍ وَلاَ يَخْطُبِ الْمَرْءُ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيهِ وَلاَ تَسْأَلِ الْمَرْأَةُ طَلاَقَ الأُخْرَى لِتَكْتَفِئَ مَا فِي إِنَائِهَا
(ক্রয়ের ইচ্ছা না থাকলে দালালী করার উদ্দেশ্যে) দাম বাড়িয়ে বলবে না, কোন ব্যক্তি যেন তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় না করে, শহরবাসী যেন গ্রামবাসীর পণ্য বিক্রয় না করে, কোন ব্যক্তি যেন তার ভাই এর বিয়ের প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব না দেয় এবং কোন স্ত্রীলোক যেন নিজের পাত্র পূর্ন করার জন্য অপর স্ত্রীলোকের তালাক দাবী না করে। [সহীহ মুসলিম, ইফা: ৩৩২৯]
৩. কোন মুমিনের ন্যায়পরয়রায়নতার বিপরীতে অন্য ধর্মের কাউকে সহায়তা করবে না এবং মুমিনের বিপরীতে তার সাথে বন্ধুত্বও করবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً ۗ وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ ۗ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ
অর্থ : মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন। [সূরা আলে ইমরান: ২৮]
৪. ঐক্য ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে তার অপর মুমিন ভাইকেই প্রাধান্য দিবে এবং তার সাথে বিভেদ করবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
আর তোমরা সকলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমর তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার। [সূরা আলে ইমরান: ১০৩]
শিক্ষা:
১. সকল প্রকার অসুস্থতায় একজন মুমিন তার অপর মুমিনের পার্শ্বে থাকবে। সাধ্যের আলোকে তাকে সহায়তা করবে।
২. তার মৃত্যু পর তার নাজাতের জন্য তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবে। তার সন্তানদের সান্তনা দিবে এবং তার দাফন কার্য শেষ করবে।
৩. বিপদে-আপদে এবং তার দাওয়াতে সাড়া দিবে।
৪. পরিচিত অপরিচিত সকল মুমিনের মাঝে সালামের প্রচলন করবে।
৫. হাঁচি দেওয়ার পর তার জন্য দুআ করবে তেমনি সর্ববস্থায় তার জন্য দুআ করবে।
৬. সার্বিকভাবে তার কল্যাণ কামনা করবে।
লেখক,হাফেজ মাওলানা নুরুল হুদা
খতিব, বাইতুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবিরহাট চট্টগ্রাম।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.