সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

সদাচারী ব্যক্তি জান্নাতি

সদাচারী ব্যক্তি জান্নাতি

সদাচারী ব্যক্তি জান্নাতি

কুরআন ও হাদিস পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায় যে, মানুষের সঙ্গে অসদাচারী আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত এবং জাহান্নামেই তার ঠিকানা হবে। সুরা হুমাজায় আল্লাহপাক বলেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে। অর্থাৎ মানুষকে হেয় করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, অপমান করে, মর্যাদাহানি করে- তা প্রকাশ্যে বা গোপনে (গিবত) তার ধ্বংস অনিবার্য। একটু গালাগাল ও গিবত করার পরিণতি যদি এই হয় তাহলে মারপিট ও গুম-খুনের পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সুরা হুমাজায় বলা হয়েছে মানুষের সাথে অসদাচরণকারী ব্যক্তির পরিণতি হলো তাকে হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। হুতামার পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে আল্লাহর আগুন – এই কথা বলে আল্লাহর ক্রোধই প্রকাশ করা হয়েছে।

মানুষ তো বটেই আল্লাহর সকল সৃষ্টিই সদাচরণের দাবিদার। মানুষের মাঝে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার। আল্লাহর পরেই তাঁদের স্থান-আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সাথে পিতামাতার সাথে সদাচরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এরপরই রয়েছে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান- সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী মোট কথা সকলের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। কেউ যদি জান্নাতের প্রত্যাশী হয় তাহলে তাকে সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

পিতামাতার সাথে সদাচরণের তাগিদ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এভাবে দিয়েছেন, তোমরা আমার আনুগত্য করো এবং, পিতা- মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’ তারা বার্ধক্যে উপনীত হলে কষ্ট পান এমন কিছুই করা যাবে না। এমনকি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। সদাচরণ সম্পর্কে ফজরের পূর্বে রিয়াদুস সালেহীন থেকে অনেকগুলো হাদিস পড়লাম। সন্তানের জন্য পিতামাতা হলেন জান্নাত। কোনো কোনো সময় জিহাদের চেয়েও বড়ো। একটু খোঁজখবর নেয়া, প্রসন্নচিত্তে তাকিয়ে থাকার মধ্যেও সওয়াব। সে সওয়াব কোনো সাধারণ সওয়াব নয়, কবুল হজের সমান সওয়াব। পিতামাতার মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য করণীয় রয়েছে। আর সর্বদা দোয়া করার কথা বলা হয়েছে এবং দোয়ার ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা।’

সদাচরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমি এরপরই নিয়ে আসতে চাই স্বামী/স্ত্রী ও আপন পরিবারের সাথে। আল্লাহপাক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা উল্লেখ করেছেন পরস্পরের বন্ধু ও সাথি হিসেবে। কেউ কারো দাসও নয় আবার প্রভুও নয়। আবার পরস্পরের পরিচ্ছদ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা নেই। যে কথা কাউকে বলা যায় না, তা বলা যায় স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে। আল্লাহ তায়ালা স্ত্রীর উপর স্বামীকে প্রাধান্য দিয়েছেন পারিবারিক জীবনে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য। আমি বলি, একটি পরিবারে স্বামী হলো রাষ্ট্রপ্রধান এবং স্ত্রী হলেন তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী। সেখানে পরামর্শ করে সকল কাজ সম্পন্ন হওয়া একান্তই কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শভিত্তিতে সম্পন্ন করে।’ সবক্ষেত্রে পরামর্শ -পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। ডিক্টেটর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সদাচরণের বিষয়ে হাদিসে কতো কথা রয়েছে – তোমাদের মধ্য ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আবার বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন স্বামী সম্পর্কে স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। সাথে সাথে এটাও বলা হয়েছে, স্ত্রীর জান্নাত নির্ভর করে স্বামীর সন্তুষ্টির উপর। স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন স্ত্রীর উপর আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদের লানত বা অভিসম্পাত দানের কথা বলা হয়েছে। যে নারী স্বামীর সন্তুষ্টি নিয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে সে জান্নাতি।

আমি আমার বেয়াইনকে জানি, যাঁর উপর তাঁর স্বামী অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। বেয়াইন আগেই মারা যান, প্রায় দিনই আমরা বেয়াইকে কিছু সময় দিতাম। কথাবার্তার মাঝে তিনি বেয়াইনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসতেন এবং চরম সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। প্রায়ই বলতেন, আমি আমার স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আশা করি আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে দিবেন। হ্যাঁ, আল্লাহর রসুল সা. নিজেই এমন নারী যার উপর তার স্বামী সন্তুষ্ট তাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। অসিয়ত অনুসারে স্ত্রীর কবরে আমার বেয়াইকে সমাহিত করা হয়।

আত্মীয়স্বজনের সাথে সদাচরণের তাগিদ স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. নানাভাবে বলেছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। কেউ যদি তার রিজিক ও হায়াত বাড়াতে চায় সে যেন আত্মীয়স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করে। আত্মীয়তার হক এটা নয় যে কেউ ভালো ব্যবহার করলে আমিও করবো বরং আত্মীয়তার হক হলো কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও আমি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবো।পাড়া-পড়শীর সাথে সদাচরণের জোর তাগিদ দিয়েছেন প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.। কতো বর্ণনা রয়েছে। বহুল প্রচলিত হাদিস, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়। একজন ব্যক্তি যদি মুমিনই না হয় তাহলে তার নামাজ-রোজা কোন্ কাজে লাগবে?

আলেমদের সাথে সদাচরণ সম্পর্কে একটু বলতে চাই। আল্লাহপাকের বক্তব্য, আলেমরা আল্লাহকে বেশি ভয় পান। যে জানে ও যে জানে না- এই দুই এক নয়। আল্লাহ ও তাঁর বিধানকে জানার কারণে স্বাভাবিকভাবে অন্যান্যদের তুলনায় আলেমদের আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা একটু বেশি। আলেমরা হলেন নবিদের ওয়ারিশ (উত্তরাধিকার)। নবি-রসুলদের যে কাজ তাদেরও একই কাজ – মানুষের কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া। এই কাজে তারা নানাভাবে নিপীড়িত- নির্যাতিত হচ্ছে। দীনের দাবি পূরণ করতে গিয়ে যারা নির্যাতিত হচ্ছে তারা মূলত নবিওয়ালা কাজ করছেন। এই কাজের বিনিময়ে তারা জান্নাত খরিদ করে নিচ্ছেন, পক্ষান্তরে যারা বিরোধিতা করছে তারা স্বেচ্ছায় জাহান্নামে নিজেদের ঠিকানা করে নিচ্ছে। আল্লাহর বাণী, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব  আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি।’

প্রশ্ন উঠতে পারে- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ছাড়া সদাচারী ব্যক্তি কি জান্নাতে যাবে? এককথায় জবাব, না (কুরআন-হাদিস তাই বলে)। মুসলমান হওয়ার সাথে এগুলো সমার্থক। মুসলমান মাত্রই নামাজি, রোজাদার, (সমর্থ না হলে ফিদিয়া দেবে), জাকাত আদায়কারী (যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে) ও হজ পালনকারী। এসব ইবাদতসমূহ ফরজ করা হয়েছে যাতে মানুষ ব্যবহারিক জীবনে মুসলমান হতে পারে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।

 

লেখক, প্রফেসর তোহুর আহমদ হেলালী

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights