জিকিরগুলোতে পাবেন অফুরন্ত কল্যাণ
আরবি জিকরুন জিকর শব্দের অর্থ স্মরণ, যার প্রকৃত স্থান হচ্ছে ব্যক্তির মন বা অন্তর। অর্থাৎ কোনো কথা মনের ভেতর জাগ্রত হলে তাকেই বলা হয় স্মরণ বা জিকর। বাংলায় জিকির বা জিকর বলতে সাধারণত আমরা বুঝি, একাকী বা দলবদ্ধ হয়ে আল্লাহর নাম, আরবি কিছু ছোট ছোট স্তুতিবাক্য অথবা আয়াতের অংশ বিশেষ বারবার উচ্চারণ বা পড়া। অথচ জিকরুল্লাহ বা আল্লাহর স্মরণ বিষয়টি এমন নয়। জানার এবং বুঝার অনাগ্রহে, সীমিত চিন্তায় জিকরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে আমরা আজও গাফেল।
জিকরুল্লাহ (আল্লাহর স্মরণ) প্রসঙ্গটি পবিত্র কুরআন মাজিদে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। কোথাও জিকর শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে, কোথাও পরোক্ষভাবে। কোথাও জিকরের স্থলে এসেছে তাসবিহ-তাহলিল, আবার কোথাও দুয়া বা ইবাদতকেও জিকর বলা হয়েছে। কোথাও জিকরের কথা বলা হয়েছে নাবী-রাসূল এবং অনুগত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ সুবাহানুতায়ালার বিশেষ নির্দেশ হিসেবে। অনুরূপভাবে কোথাও জিকর প্রসঙ্গে উল্লেখ হয়েছে সৃষ্টিলোক; ফেরেশতাকুল, পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি স্বাভাবিক নিয়ম বা ধর্ম হিসেবে। অর্থাৎ জিকর এমন একটি বিষয় যার সঙ্গে সৃষ্টিকুলের প্রতিটি কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই জিকরের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। পবিত্র কুরআনুল কারিমে এ কথার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলো হচ্ছে, সূরা আহজাব-৪১-৪২, সূরা রাদ-২৮, সূরা-মুনাফিকুন-৯, সূরা নূর-৩৬-৩৭, সূরা আনফাল-৪৫, সূরা আরাফ-২০৫ ইত্যাদি আয়াতগুলো।
অথচ আমরা অনেকে জিকর বলতে বুঝি কোনো কথা সশব্দে বা সমস্বরে উচ্চারণ করা; মনে মনে বা চুপিসারে কিছু বললে তা জিকর হয় না, ধ্যান হয়। আসলে এই জানা বা ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। যেমন আল্লাহ সুবাহানু তায়ালা পবিত্র কুরআনে আদেশ করেছেন, ‘ওয়া আকিমিস সালাতা জিকরি’ অর্থাৎ তুমি নামাজ কায়েম করো আমার জিকরের জন্য’ (সূরা ত্বাহা-১৪)। এ আদেশ মোতাবেক নামাজ কায়েমই হচ্ছে জিকরের নামান্তর। একজন মু’মিন ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালার রহমতের ছায়াবারিতে সিক্ত রাখতে নিজেকে সচেষ্ট রাখে। সে উপলব্ধি করে তার জীবনের সব প্রাপ্তি তথা জীবন মরণ প্রত্যাবর্তন সব কিছুই তার স্রষ্টা, মালিক, বিধানকর্তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। সে জানে এবং মানে একমাত্র উপাস্য মহান আল্লাহই সদা সর্বদা স্মরণীয়। তাই মুমিন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরে, মুখে ও কর্মে তার জিকর (স্মরণ) করা এবং সে তাই করে।
আল্লাহর জিকরে অপরিমেয় এবং অফুরন্ত কল্যাণ রয়েছে। যেমন- জিকর মানুষকে শয়তানের অসওায়াসা থেকে দূরে রাখে। অন্তরের দুশ্চিন্তা ও অশান্তি অপসারণ করে এবং প্রশান্তি আনয়নের মাধ্যমে নিরাময় করে মনোরোগ। চিত্তকে জীবিত, জ্যোতির্ময় এবং সংযমী করে। হৃদয়কে করে আল্লাহর অনুপম ভালোবাসায় সিক্ত সবুজ। জিকরে আত্মা হয় পরিশুদ্ধ, উদ্বেগহীন, পাপমুক্ত। একজন মুমিন জিকরের মাধ্যমেই গীবত, চোগলখুরি, গালমন্দ, মিথ্যা, অশ্লীলতা, বাজে অসার কথা এবং আল্লাহর আজাব-গজবসহ সব রকম ফিতনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। এ ক্ষেত্রে জিকরকারীর অন্তর হয়ে ওঠে সতর্ক, সংযমী, বন্ধুত্বময়, সাহায্যকারী ও প্রেরণাময়।
মুমিন ব্যক্তি যখন সর্বদা সময়মতো সালাত করেন, কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন, হাদিস শিক্ষা করেন এবং সে অনুযায়ী আমল, দোয়া-দরুদ, তাওবাহ-ইস্তেগফার ইত্যাদি নিয়মিত আমল করে, তখনই তিনি দুনিয়া-আখিরাতের কামিয়াবীর সোপানে আসন করে নিলেন। পবিত্র কুরআনে এই বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী, এদের জন্য আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা ও মহা প্রতিদান রেখেছেন (সূরা আহজাব-৩৫)।
আল্লাহর জিকর (স্মরণ) দুনিয়া আখিরাতের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী যে, তা স্বল্প কথায় বর্ণনা সম্ভব নয়। জিকর সম্পৃক্ত অনেক আয়াত ও হাদিস রয়েছে। এর মধ্যে ছোট্ট একটি হাদিসই মানুষের সচেতন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকর করল আর যে করল না, উভয়ের উদাহরণ হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির ন্যায় (বুখারি ২/৯৪৮, মুসলিম)।
সালমা সাহলি
লেখক : প্রবাসী, লসএঞ্জেলেস , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নয়া দিগন্ত
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.