নৈতিক মানস গঠনে বিশ্বনবি মুহাম্মদ সা.
নৈতিক মানস গঠনে বিশ্বনবি মুহাম্মদ সা.
মানুষ নৈতিক জীব। অন্যান্য জীব থেকে মানুষের পার্থক্যই তার নৈতিকতা। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক ও ভালো-মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন করেছে। মানুষ যখন নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে তখন সে পশুত্বের স্তরে নেমে যায়, না তারও অধম হয়ে পড়ে। আরবসহ সমগ্র বিশ্বে মানুষের নৈতিক চরম অধপতনের ফলে যখন সমাজ মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল সে সময়ে আল্লাহপাক দয়া করে নবী ও রসূল হিসেবে পাঠান আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-কে।
রসূল (সা)-এর আগমনকালে সমাজ (ঐতিহাসিকরা যেটিকে বলেছে আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগ) অধপতনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, মানুষ ভুলে গিয়েছিল সকল নীতিবোধ, আচরণে মানুষ ও পশুতে কোনো পার্থক্য ছিল না; মানবপ্রকৃতি যেটিকে ঘৃণা করে ও অন্যায় বলে জানে এমন সকল অপকর্ম যেমন, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, যিনা-ব্যাভিচার, জুলুম-নির্যাতন-হত্যা, মিথ্যা-শঠতা, ধোঁকা-প্রতারণা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, খেয়ানত, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, নারীর প্রতি অবিচার সবই সেই সমাজে চালু ছিল। এমনি সমাজে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন ব্যতিক্রম। সততা-বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার কারণে তিনি তাঁর জাতির কাছ থেকে আল-আমিন ও আস-সাদিক উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন।
জাতির সীমাহীন অধপতন মুহাম্মদ (সা)-কে ব্যথিত করতো। তাই জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা ও মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে তিনি সমবয়সীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘হিলফুল ফুযুল। কিন্তু এ-সব দিয়ে কোনো সমাধান না হওয়ায় তিনি দীর্ঘসময় হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এমনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। জিবরাইল (আ)-এর সাক্ষাত ও ওহী প্রাপ্তির মতো নতুন অভিজ্ঞতায় তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় স্ত্রী খাদিজার (রা) কাছে এসে বলেন, আমার ভয় হয়, না জানি আমার ওপর কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসে। স্ত্রী খাদিজা (রা) তাঁকে সান্ত্বনা দেন এই বলে, আপনি গরীব-দুঃখী মানুষের আশ্রয়স্থল, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচারী, সকল অন্যায় থেকে দূরে অবস্থানকারী, অতএব আপনার কোনো ভয় নেই। খাদিজা (রা) তাঁর মানবিক চরিত্রই এখানে তুলে ধরেছেন।
আল্লাহপাক মানবপ্রকৃতিতে ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণের এক সুস্পষ্ট অনুভূতি দান করেছেন। ভালো ও মন্দ কাজের একটি পরিচিতি সার্বজনীনতা লাভ করেছে। সততা, প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ, অপরের দুঃখ-ব্যথায় সহমর্মী হওয়া, গরীব-দুঃখী মানুষের কল্যাণসাধন সব ইতিবাচক কাজ নেক কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। পক্ষান্তরে মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতরাণা, নগ্নতা-বেহায়াপনা-অশ্লীলতা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, আমানতে খেয়ানতসহ নেতিবাচক কাজসমূহ মন্দ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নীতিবোধের পাশাপাশি অন্যায় করার একটি প্রবণতাও (যা শয়তান মানুষকে প্ররোচিত করে)
মানুষের মধ্যে রয়েছে। মানুষের জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ন্যায়ের পথে চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। শয়তানের ধোকা-প্রবণতা উপেক্ষা করে ন্যায়ের পথে চলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দানের লক্ষ্যে আল্লাহপাক কিতাব ও রসূল পাঠিয়েছেন।
কোনো পরাক্রমশালী শক্তির কাছে জবাবদিহির অনুভূতি এবং ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদানের প্রতি বিশ্বাস মানুষকে অন্যায় থেকে ন্যায়ের পথে চলায় সহায়তা করে। নবী-রসূলদের শিক্ষার মূল বিষয় ছিল আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নেয়া, আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও রসূলের আনুগত্য করা। কালিমা তাইয়্যেবার দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মহানত্ব তুলে ধরা ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসের সাথে সাথে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা মুহাম্মদ (সা)-এর মৌলিক কাজ ছিল। নবুয়তের প্রাথমিক অবস্থায় আখিরাতের প্রতি ঈমানকে পাকাপোক্ত করার জন্য আল্লাহপাক ভালো কাজের বদলা হিসেবে অফুরন্ত নেয়ামতেভরা জান্নাত ও মন্দ কাজের পরিণতি হিসেবে ভয়াবহ আজাবের স্থান জাহান্নামের বর্ণনা দেন। আখিরাতের বিশ্বাসই মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে এবং অন্যায় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
নবুয়তের সূচনালগ্নে বিশ্বাসের পাশাপাশি নৈতিক মানস গঠনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক মানুষকে ঈমানের সাথে নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন (সূরা আসর), ইয়াতিম ও মিসকিনের সাথে সদাচরণ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অপরকে প্রদানের কথা বলেছেন (সূরা মাউন), সামনা সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার এবং কার্পণ্যের ভয়াবহ পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন (সূরা হুমাযা), ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো ও মন্দ কাজ আমলনামায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে এবং আখিরাতে দেখতে পারবে (সূরা যিলযাল) বলে উল্লেখ করে ব্যবহারিক জীবনে সৎ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার কথাই বলেছেন। এখানে নেক কাজের (আমলে সালেহ) কোনো ফিরিস্তি দেয়া হয়নি বরং মানবপ্রকৃতি যে কাজকে নেক বলে জানে সেদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের চেনাজানা জিনিসই আল্লাহ হালাল করেছেন; আবার বলেছেন, সকল পাক জিনিসই তোমাদের জন্য হালাল (সূরা মায়েদা ৪)। এখানে মানবপ্রকৃতিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।আল্লাহপাক তাঁর নবীকে সার্টিফাই করেছেন,
‘নিঃসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’- সূরা আল ক্বলাম ৪। মুহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সুমহান নৈতিক গুণাবলির পূর্ণতা সাধনের জন্য’-ইমাম আহমাদ, আল মুসনাদ। নৈতিক চরিত্রের সকল গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। তাঁর তুলনা কেবল তিনিই। তিনি নানাভাবে তাঁর উম্মতকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম’-বুখারি ও মুসলিম। তিনি আরো বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন ঈমানদার ব্যক্তির দাঁড়িপাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে তাকওয়া ও উত্তম চরিত্র’- তিরমিযী। রসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম, সে আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আর কিয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে’-তিরমিযী।
সদাচরণ ও ন্যায়পথে চলা প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি, চাকর-চাকরানি, অধীনস্থ, প্রতিবেশি, অমুসলিম সবার সাথে সুন্দর আচরণের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। সদাচরণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। এ-কথা দ্বারা সকল সৃষ্টির সাথেই সদাচরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আবার বলেছেন, যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।
জনকল্যাণ ব্যাহত করে অর্থাৎ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সকল কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ ও কবীরা গুনাহ। সুদ, ঘুষ, খেয়ানত, ধোকা-প্রতারণা, ওজনে কারচুপি, ভেজাল, মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মাদক, যিনা-ব্যাভিচার মোটকথা সবধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ যা মানবপ্রকৃতি ঘৃণা করে মুহাম্মদ (সা) তা হারাম ঘোষণা করেছেন।
মুসলিম উম্মাহ আজ নৈতিক দিক দিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এমন কোনো অন্যায়-অপকর্ম নেই যা এই মুসলিম নামধারী ব্যক্তিবর্গ না করে। ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, হত্যা-লুণ্ঠন, ধোকা-প্রতারণা কোনো কিছু তাদের চরিত্রে বাদ নেই। প্রতিশোধ পরায়ণে হিংস্র প্রাণীকেও হার মানিয়েছে, রাজনীতিক অঙ্গনে মারামারি হানাহানি ও জবর-দখলে আমাদের সাথে কারো কোনো তুলনা নেই। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরস্পরের ভাই-এর পরিবর্তে শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মরা লাশ নিয়ে শৃগাল-কুকুর যেভাবে কাড়াকাড়ি করে তার সাথে তুলনা করলেও হয়তো ভুল হবে না। জুলুম-নির্যাতনে ফেরাউন, নমরুদ, আবু জেহেল-আবু লাহাবদের সমকক্ষ দাবী করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আল্লাহর আদালতে নিজেকে জবাবদিহি করতেই ঘর্মাক্ত হয়ে যেতে হবে; তারপর জনগণের পক্ষে জবাবদিহি কতো যে ভয়ঙ্কর তা যদি মানুষ উপলব্ধি করতো তাহলে ক্ষমতা গ্রহণ নয় বরং ক্ষমতা যাতে অর্পিত না হয় তার জন্য মানুষ পালিয়ে বেড়াতো।
নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা আজ আমাদের থেকে অনেক উন্নত। জুমু’আর খুতবায় একদিন এক খতিব মহোদয় বক্তৃতায় বললেন, তাঁর পরিচিত একজন ইউরোপ ঘুরে এসে বলছিলেন সেখানে মুসলমান না থাকলেও ইসলাম আছে। অর্থাৎ তাদের আচার-আচরণ, লেনদেন ও কাজেকর্মে সততা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রয়েছে, যা ইসলামেরই শিক্ষা। ফলে বিশ্বশাসনের দায়িত্ব আল্লাহপাক তাদের উপর অর্পণ করেছেন। এটি আল্লাহরই নিয়ম। বস্তুগত সামগ্রীর সাথে মৌলিক মানবীয় গুণে যারা সমৃদ্ধ অর্থাৎ ভাঙ্গার চেয়ে গড়ার কাজে বেশি তৎপর আল্লাহ সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব সাধারণত তাদের ওপরই দিয়ে থাকেন। মুসলমান যদি তাদের প্রিয়তম নবীর (সা) যথার্থ অনুসরণের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে তাহলে আল্লাহপাক আবারও তাদেরকে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.