সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

গ্রামে যাওয়ার পর কাজগুলো করছেন তো – ২য় পর্ব

“চলো গ্রামে যাই” (দ্বিতীয় পর্ব)

হযরত ইব্রহীম আ: ও ইসমাঈল আ: এর স্মৃতি চারণ ও নিজের প্রিয় বস্তুটিকে আল্লাহর রাহে কুরবানী এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছি আমরা। শত কষ্ট ও বিড়ম্বনাকে মাড়িয়ে আমরা ফিরছি আপন ঠিকানায়। আমরা বাংলাদেশ দাওয়া সার্কেলের পক্ষ থেকে আল্লাহর নিকট আপনার  সুন্দর ও নিরাপদ যাত্রার জন্য দোয়া করছি।

প্রিয় বন্ধুগন! আমরা নানা জন নানা পেশায় জড়িত। কর্ম ব্যস্ততার কারনে আমরা আমাদের পরিবার-পরিজন ও সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলো বা আমাদের বাড়ীর চারপার্শ্বে মানুষগুলোর খোজ-খবর নেওয়ার সময় হয়ে উঠেনা। অথচ এই মানুষগুলো সামান্য উপদেশ পেলে তারা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে নিতে পারবে।

আমরা অনেক সময় নিজ এলাকার জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকার পরও সুন্দর পরিকল্পনার অভাবে তা আর হয়ে উঠেনা। তাই সে বিষয়কে সামনে রেখে বাংলাদেশ দাওয়া সার্কেল “চলো গ্রামে যাই” একটি ছোট্ট এজেন্ডা আপনার কাছে উপস্থাপন করছে। আশা করছি আমাদের এই সামান্য চেষ্টা আপনার গ্রামে ছুটিতে কাটানো সময়গুলো কাজে লাগাতে সহায়তা করবে।

বাসায় একনজরে: 

  • আপনরা বাসার বৈদ্যুতিক সুইচ অফ করেছেন কি?
  • বাসার এসি/লাইট/ ফ্যানের সুইচ বন্ধ করেছেন কি?
  • পানির কল বন্ধ করেছেন কি?
  • গ্যাসের চুলা বন্ধ করেছেন?
  • মশা বা বিভিন্ন জীবানু জন্মাতে পারে এমন পাত্রে পানি জমা রাখবেননা। যেমন: ওয়াস রুমে বদনা, বালতি বা কোন পাত্রে যাতে পানি জমে না থাকে তার জন্য পাত্রগুলো উপর করে রাখুন।
  • বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জানালাগুলো লাগিয়ে যাবেন।
  • বাসার ময়লাগুরো বাহিরে রাখুন।
  • বাসার চাবি নিরাপদ স্থানে রাখুন।

বাড়ীর পথে

  • আপনার সকল মালপত্র বুঝে নিন।
  • গাড়ী/লঞ্চ/ট্রেনের টিকিট , মানি ব্যাগ, এটিএম কার্ড, ক্র্যডিট কার্ড ইত্যাদি যত্নে রাখুন।
  • যাত্রাকালে পড়ার জন্য বই নিয়ে নিতে পারেন।
  • নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে গাড়ীর কাউন্টারে আসার চেষ্টা করুন।
  • বাড়ীর লোকজনের জন্য মৌসুমী ফল/ অন্য কোন নাস্তার আইটেম কিনে নিতে পারেন। বিশেষ করে শিশু ও আপনার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য তাদের পছন্দের কিছূ কিনে নিতে পারেন।
  • গাড়ীতে/লঞ্চ/ট্রেনে উঠার সময় আপনার কোচ নাম্বার মিলিয়ে নিন।
  • কাউন্টার থেকে আপনার সকল মাল-পত্র বুঝে নিন।
  • ডান পা দিয়ে গাড়ীতে/লঞ্চ/ট্রেনে উঠুন।

গাড়ীতে উঠার পর নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ুন :

اَلٛحَمٛدُ لِلّٰهِ سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَٰذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِين

(উচ্ছারন: আলহামদুলিল্লাহি সুবহানাল্লাযি সাখ্খার-লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন)

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি পবিত্র ও মহান,তিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন,যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলামনা।

  • লঞ্চে উঠার পর নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ুন:

بِسْمِ اللَّهِ مَجْرَاهَا وَمُرْسَاهَا ۚ إِنَّ رَبِّي لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

(উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া-মুরসাহা ইন্না রাব্বী লা গাফুরুর রাহীম)

অর্থ: আল্লাহর নামেই এর চলাচল ও স্থিতি। আমার পালনকর্তা আতি ক্ষমপরায়ণ ও মেহেরবান।( সূরা হুদ:৪১)

(উচ্ছারন: আলহামদুলিল্লাহি সুবহানাল্লাযি সাখ্খার-লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন)

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি পবিত্র ও মহান,তিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন,যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলামনা।

  • গাড়ীতে/লঞ্চ/ট্রেনে বসে আজে-বাজে চিন্তা অথবা নাটক মুভি না দেখে কোন ইসলামিক বই পড়ুন। অথবা মোবাইলে কুরআন , হাদিস বা অন্য কোন বই পড়ুন । অধিক পরিমানে আল্লাহকে স্বরণ করুন।
  • যে সকল বাস, /লঞ্চ/ট্রেনে অশ্লীল নাটক/ সিনেমা চলে তবে ‍সুন্দর ভাষায় তা বন্ধ করা চেষ্টা করুন এবং ইসলামিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা চালাতে বলূন। এতে আপনার রুচির সৌন্দর্যতা ফুটে উঠবে।
  • যাত্রাপথে ড্রাইভারকে সালাতে বিরতী দিতে বলুন এবং নিজে সালাত আদায় করুন। এতে আপনার দাওয়াতী কাজও হয়ে যাবে।
  • স্বরণ রাখুন যদি আপনি ৪৮ মাইলের বেশি যাত্রার কারণে তবে আপনার এলাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি মুসাফির। তাই ৪ রাকাত বিশিষ্ট নামাজ ২ রাকাত করে পড়ুন তবে জামাতে হলে ৪ রাকাত পড়ুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَاِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ

“যখন তোমরা যমিনে ভ্রমন করো তখন নামাজে কিছুটা হ্রাস করলে তোমার কোন গুনাহ হবেনা। (সূরা নিসা: ১০১)

  • যদি একান্ত গাড়ী না থামায় তবে কিবলা নির্ধারণ করে গাড়ীতে বসেই পড়ে ফেলুন।
  • আপনার প্রয়োজনী জিনিসপত্র আপনার সাথেই রাখুন।
  • পাশের যাত্রীর সাথে পরিচিত হউন।
  • সন্দেহজনক/ অপরিত লোকের দেওয়া কিছু খাবেননা। বেশি আগ্রহ দেখালে ভদ্রতার সাথে না বলে দিন।
  • গাড়ী থেকে নামার পূর্বে আপনার ব্যাগ সামান বুঝে নিন।
  • গাড়ী থেকে নামার সময় বাম পা দিয়ে নামুন।

বাড়ীতে পৌঁছার পর করণীয়:

  • বাড়ীতে ঢুকে সকলের সাথে সালাম বিনিময় করুন।
  • মুখে সালাম দিন, পায়ে ধরে নয়। কারন এটি সুন্নাত পদ্ধতি নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
  • মুরুব্বীদের খোজ খবর নিন, তাদের উপহার বুঝিয়ে দিন।
  • বাড়ীর ছোটদের খোজ-খবর নিন। বিশেষ করে তারা সালাত পড়ে কিনা?এবার রোজা কতটি রেখেছে? পড়া-লেখা ভালোভাবে করে কিনা? তাদের চকলেট জাতীয় উপহার দেওয়ার চেষ্টা করুন।

বেশি বেশি তাকবীর পাঠ করুন:

اَللهُ أكْبَرْ اَللهُ أكْبَرْ اَللهُ أكْبَرْ ، لَا إِلٰهَ إِلَا اللهُ، اَللهُ أكْبَرْ اَللهُ أكْبَرْ ، وَ لِلّٰهِ الْحَمْدِ
বাংলা উচ্ছারণ: আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরোয়া মাহফিল:

আমরা সবসময় বন্ধু-বান্ধব বা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে ভালো কাজের বা মাহফিলের আয়োজন করি। তাদের বিভিন্ন ইবাদতের কথা বলি। কিন্তু আমরা আমাদের পরিবারকে ইসলামের দাওয়াদ দিতে বেমালুম ভুলে যাই। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

পরিবারকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার সুন্দর কয়েকটি পদ্ধতি হলো:

  • পরিবারের সকলকে আপনার পক্ষ থেকে ইফতারের দাওয়াত দিন।
  • পরিবারের ঐ দিনের সকল ইফতার আপনি বাহির থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসুন।
  • আসরের নামাজের পর পর পরিবারের সকল সদস্যদের একত্রিত করুন।
  • যদি আপনার কুরআন-হাদীসের যথেষ্ট জ্ঞান থাকে তবে আপনি নিজেই রমজানের শিক্ষা সহ ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তাদের নিকট সুন্দরভাবে উপস্থাপন করুন। এক্ষেত্রে সালাত, পারিবারিক পর্দা, গীবতের ক্ষতিকর দিক ও মোবাইলে বিভিন্ন অশ্লীলতার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরুন।
  • যদি আপনার কুরআন-হাদীসের যথেষ্ট জ্ঞান না থাকে তবে একজন আলেম অথবা সমাজের ইমামকে দিয়ে উল্লেখিত বিষয়ের উপর আলোচনা করাতে পারেন। এক্ষেত্রে মিলাদ মাহফিল নামে বিদাআত বর্জন করতে হবে।
  • পরিবারে ইসলাম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
  • নিজের ছেলে-মেয়েকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান দান করুন।

বাড়ীর লোকজনকে সময় দান:

  • আপনার বাড়ীর লোকজনের সাথে মনমালিন্য থাকলে তা মিটিয়ে ফেলুন। তার খোজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • বাড়ীর সামষ্ঠিক কোন সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা করুন। পুকুর ঘাট, বাড়ীর রাস্তা, বাথরুম ইত্যাদির সমস্যার সমাধান করুন।
  • বাড়ীর যুবকদের খোজ-খবর নিন, তাদের সালাত ও পড়া লেখার খোজ-খবর নিন। কোন মৌলিক সমস্যা থাকলে তা সমাধানে সাধ্যমত চেষ্টা করুন।
  • বাড়ীর কোন শিক্ষার্থীর পড়া লেখার জন্য কোন আর্থিক সহায়তা লাগলে যথাসম্ভব সহায়তা করুন। এতে আপনি তাদের নিকট গ্রহণীয় হয়ে উঠবেন।
  • বাড়ীর ছোটদের নাম মনে রাখুন এবং তাদের স্বল্প হলেও ঈদ বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • বাড়ীর ছোটদের ইসলামের মৌলিক বিষয়ে নসিহত করুন। যেমন: তাওহীদ, রেসালাত, শিরক, নামাজ ইত্যাদি।

আত্মীয় স্বজনের খোজখবর নেওয়া:

  • ঈদের ছূটিতে বাড়ীতে গিয়ে ঘরকুনো ব্যঙের মতো ঘরে বসে না থেকে আত্মীয় স্বজনকে সময় দিন।
  • মৃত আত্মীয়দের কবর জিয়ারত করুন।
  • গরীর আত্মীয় সজনদের যথা সম্ভব সাহায্য করুন। আর যদি তারা যাকাত খাওয়ার উপযোগী হন তবে তাদের যাকাত দিন।
  • কুরবানীর মাংশ গরীব আত্মীয়তের বাসায় পৌঁছিয়ে দিন।

কুরবানীর শিক্ষা

১. কুরবানীর জন্য একনিষ্ঠ নিয়ত করুন।

২. ত্যাগের মানুষিকতা নিয়ে কুরবানী করুন।

৩. কুরবানীর পশুর প্রতি দয়াশীল হউন।

৪. ইব্রাহীম আ: এর মতো আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে নিজের জীবন উৎসর্গ করুন।

৫. চতুস্পদ জন্তুর সাথে সাথে আপনার মনের মধ্যে লালিত পশুত্তকেও কুরবানী করুন।

৬. কুরবানীর গোস্ত বিনিময় হিসেবে নয বরং সন্তুস্ট চিত্তে দান করুন।

৭. কুরবানীর চামড়া এতিমখানা, ফকির মিসকিন অথবা দ্বীনি সংগঠনে দান করুন।

৮. ইব্রাহীম আ: জীবনী পড়ুন ও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে শিরক মুক্ত পরিবার ও সমাজ গড়ুন।

৯. সকল নমরুদী শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন।

১০.আল্লাহর রাস্তায় নিজের জীবনের সবচেয়ে উত্তম জিনিস কুরবানী করুন।

১১.কুরবানীর বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।

১২.কুরবানীর পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ দুষণ করবেন না।

১৩.পরিস্কর পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। তাই নিজের বাড়ীর আঙ্গিনা পরিস্কার রাখুন।

১৪.কুরবানীর গোস্ত ফ্রীজে জমা না রেখে গরীব-মিসকিন ও আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করুন।

১৫.কুরবানী পশুর দাম অযথা বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থাকুন।

১৬.কুরবানী পশুর হাটে নামাজের ব্যাবস্থা সহ সার্বিক পরিবেশ নিরাপদ রাখুন।

১৭.আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে ঈসমাইল আ: এর মতো নিজের সন্তানদের তৈরী করুন।

১৭.কুরবানীর মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করুন।

১৮. বেশি বেশি তাকবীর পাঠ করুন।

সমাজ সেবা:

শহর থেকে আপনার যারা বাড়ীতে যান তারা তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত ও সচেতন এবং গ্রামের মানুষগুলো আপনার থেকে কিছু শুনার জন্য প্রস্তুতও থাকেন। তাই যারা গ্রামে যাবেন তাদের কয়েকটি কাজ বেশি করা দরকার।

  • মাদক বিরোধী সচেতনতা তৈরীতে পদক্ষেপ নিন ও সহায়তা করুন।
  • যৌতুক বিহীন বিয়ের আয়োজন করা যেতে পারে।
  • এলাকার গরীব দুঃস্থদের মাঝে যাকাত বিতরণ করুন।
  • কোন রাস্তা ঘাটের সমস্যা থাকলে তা যৌথ উদ্দোগ নেন।
  • ইসলামিক জলসার আয়োজন করা যেতে পারে।
  • মানুষের নিকট ইসলামের সঠিক মেসেজ তুলে ধরুন।

আল্লাহ তায়ালা আপনার ভ্রমনকে সুখময় ও আনন্দদায়ক করুন। আপনার প্রত্যাবর্তন নিরাপদ হউক। আমীন।

 

লেখক, হাফেজ, মাও: নুরুল হুদা

কুরআনিক সায়েন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবির হাট, চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.