আমরা বড়ো ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার বাসিন্দা
আল্লাহর জিজ্ঞাসা- ‘তার ধন-সম্পদ কোন্ কাজে আসবে যখন সে ধ্বংস হয়ে যাবে?’- সুরা আল লাইল ১১
আমরা বড়ো ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার বাসিন্দা
আল্লাহর জিজ্ঞাসা- ‘তার ধন-সম্পদ কোন্ কাজে আসবে যখন সে ধ্বংস হয়ে যাবে?’- সুরা আল লাইল ১১
মানুষ ধন-সম্পদের মায়ায় বড়ো কাতর। যার যতো বেশি আছে সে ততো চায়। এমন কি কবরে পৌঁছার আগ পর্যন্ত (সুরা তাকাসুর) সে চায়। রসুলুল্লাহ সা. কতো সুন্দরভাবেই না বলেছেন। মানব সন্তানকে এক উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ দিলে সে আর একটি চায়। মাটি ছাড়া কোনো কিছু তাকে তৃপ্ত করতে পারে না। লিও টলস্টয়ের একটি গল্প পড়েছিলাম- একজন মানুষের কতটুকু জমির প্রয়োজন? লোকটিকে বলা হয়েছিল, সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটুকু আয়ত্ত করতে পারবে ততটুক তাকে দেওয়া হবে। যতো সামনে এগোয় ততই তার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। সূর্য গড়িয়ে পড়লে সে সম্বিত ফিরে পায় এবং ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসে প্রাণ হারায়। তাকে তখন সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে দাফন করা হয়। এই সাড়ে তিন হাত জমিই তার প্রয়োজন। গল্পের সার কথা।সারা বিশ্বকে আল্লাহপাক তাঁর এক অতি ক্ষুদ্র জীবাণু দ্বারা নাড়া দিয়েছেন। মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মৃত্যুহার খুব বেশি না হলেও মানুষের অন্তরে আল্লাহপাক ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সমগ্র বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনা আক্রান্তকে সবাই ভয় পাচ্ছে। অনেক সম্পদ, মান- ইজ্জত- সম্মান, সন্তান-সন্ততি থাকা সত্ত্বেও বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের ঘটনাও শ্রুতিগোচর হচ্ছে। এসবই আমাদের জন্য সতর্কবার্তা।
সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিছু বিধি-নিষেধ আছে। ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বাধা নেই। হযরত ওছমান রা. তার একজন বড়ো উদাহরণ এবং ধনাঢ্যতার কারণে তাঁকে গণি বলা হয়। আমাদের মোনাজাত- ‘হে রব! তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দাও।’ জাকাত একটি ফরজ ইবাদত। এ ইবাদত তারাই পালন করতে পারে আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন। ধনী হওয়ার সুযোগ থাকে ব্যবসা- বাণিজ্যের মধ্যে। ইসলামে ব্যবসাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর মুখনিঃসৃত বাণী, ‘রুজির দশ ভাগের নয় ভাগ রয়েছে ব্যবসায়ে এবং একজন সৎ ব্যবসায়ী সিদ্দিকদের সমপর্যায়ভুক্ত।’
অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিষয়টি ইসলামে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অবৈধ উপার্জনে গঠিত শরীর জাহান্নামের লাকড়ি বৈ আর কিছু নয়। হারাম উপার্জনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুদ, ঘুষ, খেয়ানত, কাজে ফাঁকি, ওজনে কম- বেশি, ধোকা-প্রতরাণা, ভেজাল, মজুদদারী, লটারি, জুয়া, ধোকা-প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার যতো উপায় আছে সবই হারাম এবং পরিণতি জাহান্নাম।
সরকারি কর্মকাণ্ড ও রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। রাজনীতি বর্তমানে দ্রুত ধনী হওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখা দেয়ায় দেশের ব্যবসায়ীদের ব্যবসার চেয়ে রাজনীতির প্রতি আগ্রহটা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের দুর্নীতির কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত। সীমাহীন দুর্নীতি ও অবিশ্বাস্য দুর্নীতির কথা শ্রুত হয়। শেয়ারবাজার কেলেংকারী, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, ডেসটিনি বড়ো বড়ো দুর্নীতির পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরে কেনাকাটায় দুর্নীতির যে চিত্র তা অনেকটাই অবিশ্বাস্য। এরাই দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে এবং দেশ থেকে সম্পদ পাচারের হোতাও এই দুর্নীতিবাজরা।
মানুষ চিরন্তন জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। প্রতিনিয়ত আমরা মৃত্যুসংবাদ শুনি। ফেসবুকের বদৌলতে প্রিয়জনদের মৃত্যুসংবাদ প্রদান, মাগফেরাত কামনা, সমবেদনা জ্ঞাপন লেগেই আছে। আমিও যে ঐ মিছিলের একজন সেটি আমরা স্মরণ করতে পারছি না। দুনিয়ার নাম- যশ-খ্যাতি ও সম্পদের নেশা পরকালের ব্যাপারে আমাদেরকে গাফেল করে রেখেছে। অথচ এর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। মৃত্যুর সাথে সাথে সম্পদের আমরা আর মালিকানা থাকি না। একেবারে শূন্যহাতে পৃথিবী থেকে আমাদের বিদায় নিতে হয়। আল্লাহর জিজ্ঞাসা- এই ধন-সম্পদ তার কোন্ কাজে লাগবে? সম্পদ যথাযথ পন্থায় উপার্জন ও ব্যয় এবং আল্লাহর পথে হলে পুরোটাই হবে ইবাদত ও তার জন্য কল্যাণকর। অন্যথায় সেটি হবে ভয়াবহ আজাবের কারণ।
হালাল উপার্জন ইসলামের প্রাণ এবং ইবাদত কবুলের শর্ত। দেশ পরিচালনায় রাজনীতিকদের সাথে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও সংশ্লিষ্ট। উভয় শ্রেণী সমাজে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষে। কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয়প্রাপ্তদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণ শাসকরা থাকবেন। শাসক বলতে একজন ব্যক্তি নন জনগণকে শাসন করার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকেই বোঝায়। শাসকরা ন্যায়পরায়ণ না হয়ে যদি জালেম হয় তাহলে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা। রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীরা খেয়ানত করলে এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে করুণ পরিণতির কথা রসুল সা. বলে গেছেন। এই শ্রেণী সম্পর্কে বলেছেন, এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস কেউ যদি খেয়ানত করে তাহলে কেয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। আবার দায়িত্বে অবহেলা করলে তার পরিণতি এভাবে বলা হয়েছে, নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে করে সরকারি দায়িত্ব সেভাবে পালন না করলে কেয়ামতের দিন উল্টাভাবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারি দায়িত্ব একটি আমানত। এখানে দায়িত্বে অবহেলা, সরকারি সম্পদের অপচয়/অপব্যবহার/তসরুপ/আত্মসাৎ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হাদিসের ভাষায় মুনাফিকদের কয়েকটি খাসলতের মধ্যে অন্যতম হলো খেয়ানত করা। কোনো এক যুদ্ধে নিহত একজন ব্যক্তি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, লোকটি জাহান্নামী। সাহাবায়ে কেরাম তাজ্জব হয়ে যান, কারণ সে তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে শহিদ হয়ে গেছেন। পরে খোঁজ করে তার মাল-সামানের মাঝে গণিমতের একটি মাল পাওয়া যায়। যুদ্ধের ময়দানে একটি বাটি বা ক্ষুদ্র কিছু একটা আত্মসাৎ করার পরিণতি যদি সরাসরি জাহান্নাম হয় তাহলে এই পুকুর চুরি, সাগর চুরি বা ঘুষ বাণিজ্যের সাথে যারা জড়িত তাদের পরিণতি হাবিয়া বৈ আর কী হবে? আল্লাহর রসুল সা.-এর প্রকাশ্য ঘোষণা রয়েছে ‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই দোযখী’।
বাংলাদেশ ঘুষ-দুর্নীতির এক স্বর্গরাজ্য। করোনা ভাইরাস আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। যাদের মধ্যে ঈমান রয়েছে তবে দুর্বল অবস্থায় এই করোনা তাদের দুর্বলতা দূর করার জন্য যথেষ্ট। কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হবে না, গুনাহ মাফ হবে তখনই যখন অবৈধ সকল উপার্জন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বা সংশ্লিষ্টদের কাছে ফেরৎ দানের সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হবে। ঈমান যদি কারো প্রিয় হয় এবং পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি ও জাহান্নামের ভয় থাকে তাহলে অবৈধ সম্পদ ফেরৎ দেওয়া তার জন্য মোটেই কঠিন হবে না। আল্লাহপাক আমাদেরকে তওবা করে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন।
১৫.০৬.২০২৩
প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.