সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তার ব্যবহার

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা এক নিখুত ও অতুলনীয় স্রষ্টা। সৃষ্টির দিকে নজর করলেই তাঁর নিপুন দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর এই নিপুন সৃষ্টিতে রয়েছে নানা বৈচিত্র। আর সৃষ্টির এই বৈচিত্রের পিছনে রয়েছে তাঁর বিশাল মহা পরিকল্পনা। সূরা হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির বৈচিত্র বর্ণনা করে বলেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

“হে মানব সম্প্রদায়, অবশ্যই আমি তোমাদের একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিতি হতে পারো। কিন্তু আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্য সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।

এমনি ভাবে আল্লাহ তায়ালা বৈচিত্রতা দান করেছেন মানুষের মাতৃভাষার ভিতরেও। প্রতিটি মাতৃভাষাই আল্লাহর অপরুপ সৃষ্টি। এই চমৎকার সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় ফুটে ওঠে। পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা রয়েছে প্রত্যেকটি ভাষাই তার জাতিসত্ত্বার পরিচয় বহন করে। এই ভাষাগুলো কোন মানুষ বা বিজ্ঞানী পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেনি। বরং তা এক অদৃশ্য শক্তি বা নিখুত স্রষ্টার মহা পরিকল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে আল্লাহ তায়ালা সূরা আর রাহমানের ১-৪নং আয়াতে বলেন:

الرَّحْمَن, عَلَّمَ الْقُرْآنَ, خَلَقَ الْإِنسَانَ, عَلَّمَهُ الْبَيَانَ

“ পরম করুণাময় (আল্লাহ তায়ালা), তিনি তোমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন; তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আর তিনি তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন”। অর্থাৎ মানুষ যে ভাষাই কথা বলে তা তার মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষা হলো আল্লাহর সৃষ্টি। এটি আল্লাহর নেয়ামত, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোন মানুষ বলতে পারে নি যে এই ভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। উপরন্ত এই আধুনিক সময়েও অনেক ভাষার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ভাষা সৃষ্টি করতে পারে না, সর্বচ্ছো সে ভাষার আকার আকৃতি পরিবর্তন পরির্ধন করে নিজের ভাষা অন্যের বোধগোম্য করে নিতে পারে। তাই আমাদের স্বীকার করে নিত হবে যে, প্রতিটি ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি আর তাই প্রতিটি ভাষার প্রতি থাকতে হবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাছাড়া ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ্য থেকে এক বিশাল নিয়ামত। কারণ অন্যান্য পশু-পাখি নির্দিষ্ট একটা শব্দের মাধমে তাদের সকল ভাব প্রকাশ করে। যেমন: সুখে-দু:খে সর্বাবস্থায় কুকুর ঘেউ, ঘেউ করে, পাখি কিচির-মিচির, বিড়াল মেওউঁ মেওউঁ, গরু হাম্বা, হাম্বা ইত্যাদি করতে থাকে। কিন্তু মানুষ একমাত্র প্রাণী যে কিনা তার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা কথার মাধ্যমে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তাইতো বলা হয়, দয়াময় আল্লাহ মানুষকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব:

একজন মানুষের কাছে যেমন নিজের ভাব প্রকাশ করার জন্য নিজের মাতৃভাষা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও সহজতর ঠিক তেমনি ইসলামেও মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট স্পষ্ট ও বোধগম্য ভাষায় পৌঁছানোর জন্য ইসলাম মাতৃভাষাকে শুধু গুরুত্বই দেইনি বরং মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“আমি প্রত্যেক নবীকেই তাঁর স্ব-জাতির (মাতৃ)-ভাষায় প্রেরণ করেছি, যাতে করে সে তাদের কাছে আমার (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারে। (সূরা ইবরাহীম: ৪) কুরআনের এই শাশ্বত আয়াতই প্রমান করে যে, আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে মাতৃভাষার গুরুত্ব কতখানি। নবী ও রাসূলগণ যদি তাদের কওমের মাতৃভাষায় আল্লাহর বানী প্রচার না করে নির্দিষ্ট কোন ভাষা চাপিয়ে দিতেন তবে তাঁদের উম্মাতেরা হেদায়েতের বাণী গ্রহণ করতো না এবং হেদায়েত গ্রহণ না করার অন্যতম অজুহাত হিসেবে ভাষা না বুঝাকে দায়ী করতো। তাই মানুষের সকল অজর আপত্তি নিরসনকারী মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের ভাষায় ওহী পাঠিয়ে তাদের অজুহাতের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন।

ইসলামে মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের গুরুত্ব:

ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপের পাশাপশি মাতৃভাষা শুদ্ধরুপে উচ্ছারনের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহর রাসূল স: তাঁর জাতির মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। একটি দূর্বল বর্ণনায় ইবনে কাসীর র. বর্ণনা করেন “রাসূল স: বলেন, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী”।

অপরদিকে চরম আল্লাহদ্রোহী ফেরআউনের নিকট তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য যখন মুসা আ: আদিষ্ট হয়েছেন তথন তিনি তার মুখের জড়তার কথা আল্লাহ তায়ালার নিকট তুলে ধরেন এবং স্পষ্ট ও শুদ্ধভাষী হিসেবে ভাই হারুন আ: কে নিজের দাওয়াতী সঙ্গী হিসেবে আল্লাহর নিকর পার্থনা করেন। পবিত্র কুরআন এই কথাকে এইভাবে বর্ণনা করে:

وَأَخِى هَـٰرُونُ هُوَ أَفۡصَحُ مِنِّى لِسَانً۬ا فَأَرۡسِلۡهُ مَعِىَ رِدۡءً۬ا يُصَدِّقُنِىٓ‌ۖ إِنِّىٓ أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ

“(হে প্রভূ) আমার ভাই হারুন আমার ছেয়ে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহার্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন। যাতে করে সে আমাকে সমর্থন করতে পারে। (সূরা কাসাস: ৩৪)

সুতরাং আলোচ্য আয়াত থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে বিশুদ্ধ ভাষার বিকল্প নেই।

মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা:

আমাদের সমাজে কিছু মানুষের মাঝে একটি কথা খুব বেশি প্রচলিত আছে যে, ইসলামকে আরবী ভাষাতেই চর্চা করতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো অনেক ইসলামী চিন্তাবিদকেও বলতে শুনা যায় যে, অমুক তো বাংলা বুখারী পড়ে আলেম হয়েছে, তার থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানা যাবে না। এটি একটি অজ্ঞতাপূর্ণ কথা। কারণ প্রতিটি নবীর কাছে শরীয়তের বিধান নাযিল হয়েছেন তার স্বজাতির ভাষায় যাতে করে তারা এর নিগূঢ় তত্ব উপলব্ধি করতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“আমি প্রত্যেক নবীকেই  তাঁর জাতির (মাতৃ)-ভাষায় প্রেরণ করেছি, যাতে করে সে তাদের কাছে আমার (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারে। (সূরা ইবরাহীম: ৪)। যেহেতু রাসূল স: ছিলেন আরবী। আর তৎকালীন সময়ে আরবী ভাষাই ছিলো সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানে বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত ভাষা। তাই কুরআন আরবীতে নাযিল হয়েছে এবং রাসূল স: এর পবিত্র হাদিস ও ইসলামী শরীয়তের হুকুম আহকাম আরবীতেই রচিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হওয়ায় তা অনারবীদের কাছে পৌঁছে যায়। তাই অনারবীদের নিকট ইসলামকে সহজ ও বোধগম্য করে তুলতে তাদের নিজেদের ভাষার বুঝার বিকল্প নেই। তাছাড়া ইসলাম এতে উৎসাহ দিয়েছে। সুতরাং কেউ যদি নিজের মাতৃভাষায় দ্বীন বুঝার চেষ্টা করে তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আবার কেউ যদি শরীয়তের মূল ‍উৎস থেকে দ্বীন বুঝে তবে তা অধিকতর উত্তম। তাই সাধারণ মানুষের নিকট ইসলামকে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই।

ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষার অপব্যবহার:

মানুষের মুখের ভাষা আল্লাহর দান। এই ভাষা কখনো মিষ্টি-মধুর, আবার কখনো তা হয় কর্কশ-কঠিন। এই ভাষাকে ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন মানুষের মন জয় করা যায়, মানুষকে আনন্দিত করা যায়, সুখে-দ:খে উৎসাহ-শান্তনা দেওয়া যায় ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে জিহ্বা নামক তলোয়ার দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করা যায়।, তাকে মানুষের মাঝে ছোট, হেয় প্রতিপন্ন করে অপমান করা যায়। তাই বলা হয় জিহ্বার ব্যবহারেই শত্রু-মিত্র চিনা যায়। আর এই জিহ্বা দিয়ে মানুষ তার শত্রুকে প্রথম আঘাত হানে। জিহ্বার আঘাত এতো মারাত্মক যে, আরব কবি  ইয়াকুব হামদূনী তা বুঝাতে গিয়ে বলেন:

আশা করা যায় তরবারীর আঘাতের ক্ষত নিরাময় হবে

কিন্তু জিহ্বার আঘাতের ক্ষত নিরাময় হবে না।

তরবারীর আঘাতে যদি কোন ক্ষত হয় তা চিকিৎসার মাধ্যমে সারানো সম্ভব,

কিন্তু জিহ্বার মাধ্যমে যে ক্ষত তা সারানো সম্ভব নয়।

তলোয়ারের আঘাত একদিন মিশে গিয়ে ভালো হয়ে যাবে,

কিন্তু জিহ্বার আঘাত অনন্তকাল থেকে যাবে।

সুতরাং জিহ্বা আপনার তাই এর যাচ্ছে তাই ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। একজন আদর্শ ও বিবেকবান মুসলিম তার জিহ্বাকে হেফাজত রাখে। কারণ তার প্রতিটি কথারই হিসাব গ্রহন করা হবে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন:

مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

“মানুষ এমন কোন কথা বলেনা যা লিপিবদ্ধ করা হয় না। (সূরা ক্বফ: ১৮)

মুখের ভাষা সংযতকারীর জন্য পুরস্কার হিসেবে রাসূল স: বলেন:

مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ

“যে ব্যক্তি আমাকে জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের নিরাপত্তা দিবে আমি তাকে জান্নাতের নিরপত্তা দিবো। (বুখারী:৬৪৭৪)

জিহ্বার মাধ্যমেই মানুষের জীবনের অধিকাংশ অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকে। তাই যারা নিজেদের জিহ্বা সংযত রাখতে পারে না রাসূল স: তাদের ব্যাপারে বলেন:

مَن كان يؤمن بالله واليوم الآخر، فليقُلْ خيرًا أو ليصمُتْ

“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারী:৬০১৮, মুসলিম:৪৭)

সবশেষে আমরা এ কথা বলতে পারি ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত। এই নিয়ামতের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা মানুষের মন জয় করে নিতে পারি। বাংলায় একটি বিখ্যাত উক্তি আছে “ ব্যবহারে বংশের পরিচয়”। সুতরাং আমাদের মুখের ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন হওয়া উচিত। সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার করি। অন্যের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই।

 

লেখক, হাফেজ, মাও: নুরুল হুদা

কুরআনিক সায়েন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবির হাট, চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights