যাকাত কাকে বলে ইসলামী অর্থনীতির মূলভিত্তি
“যাকাত” ইসলামী অর্থনীতির মূলভিত্তি
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান গুছিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করণার্থে যাকাতের ভুমিকা অবিস্বরনীয়। একমাত্র যাকাত ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই সমাজ থেকে অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করা সম্ভব। যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি কায়েমের জন্য প্রয়োজন যাকাত সম্পর্কে জানা ও সচেতন হওয়া।
যাকাতের পরিচয়: যাকাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ: বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্র হওয়া ও বরকত বা সমৃদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন: خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا – “তাদের সম্পদ থেকে তুমি সদকা গ্রহণ করো, যা দিয়ে তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং কল্যাণ ও উন্নত সাধন করবে।” (সূরা তাওবা:১০৩)
শরীয়তের পরিভাষায়-মানুষ তার সম্পদ থেকে শরীয়ত নির্ধারিত আল্লাহর যে প্রাপ্য অংশ দরিদ্রের জন্য বের করে দেয় তার নাম যাকাত। ঈমান ও সালাতের পরে যাকাত ইসলামে তৃতীয় স্তম্ভ। ইসলামের অনেক ফরজ ইবাদত কুরআনে ২/৪ উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু যাকাত এমন একটি অর্থনৈতিক ইবাদত যা সালাতের পরে কুরআনে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। তাই যাকাত না দেওয়া ও তা অস্বীকার করা কাফিরের বৈশিষ্ট এবং জাহান্নামে শাস্তির অন্যতম কারন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِينَ، الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ – ধ্বংস মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত প্রদান করে না, ( সূরা ফুসিসলাত: ৬-৭)
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে যে, জাহান্নামীদের জাহান্নামে আসার কারন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা নামাজ ও যাকাত ত্যাগের কথা বলবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ، وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ – “আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। আর আমরা দরিদ্রগণকে খাওয়াতাম না। (সূরা মুদ্দাসিসর: ৪২-৪৩)
আমরা মনে করি যাকাত দানে সম্পদ হ্রাস পায়। এটি একটি চরম ভ্রান্ত ধারণা। কারণ আপনার নিকট গচ্ছিত সম্পদ যখন আপনি অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিবেন তখন তারা জমা রাখবে না । বরং তা খরছ করবে। আর এই খরছই আপনার অর্থনীতির চাকাকে সচল করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ – “আল্লাহ তায়ালা সুদের বৃদ্ধিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন আর ‘সাদকাহ’ বা যাকাতকে বৃদ্ধি করেন।” (সূরা বাকারা: ২৭৬)
আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন: وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ ۖ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ – “ এবং তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যা যে বৃদ্ধি ( সুদ) প্রদন কর তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা যে যাকাত প্রদান করে থাক সেই যাকাতই হল বহুগুণ বৃদ্ধিকারী।” (সূরা রুম: ৩৯)
যাকাত দাতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল স: সুসংবাদ দিয়ে বলেন: ثَلَاثٌ مَنْ فَعَلَهُنَّ فَقَدْ طَعِمَ طَعْمَ الْإِيمَانِ: مَنْ عَبَدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَأَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَعْطَى زَكَاةَ مَالِهِ طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُهُ – “যে ব্যক্তি তিনটি কাজ করবে সে ঈমানের স্বাদ ও মজা লাভ করবে: যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, জানবে যে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আনন্দিত চিত্তে পবিত্র মনে তার সম্পদের যাকাত দিবে। (আবু দাউদ: ১৫৮২)
রাসূল স: আরো এরশাদ করেন: مَنْ أَدَّى زَكَاةَ مَالِهِ ، فَقَدْ ذَهَبَ عَنْهُ شَرُّهُ – অর্থ: যে তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়।( মুজামুল আওসাত লিত তাবরানী: ১৬০৮)
যারা যাকাত প্রদান করে না তাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন: وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ “আর যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।( সূরা তাওবা: ৩৪)
যারা যাকাত প্রদান করবে না তারা জাহান্নামে প্রবেশকারীদের মধ্যে আগ্রগামী হবে। যারা যাকাত প্রদান করে না তাদের সম্পর্কে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন: وأما أول ثلاثة يدخلون النار: فأمير مسلط، وذو ثروة من مال لايودي حق الله من ماله، وفقير فخور – “প্রথম যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তারা হলো সেচ্ছচারী শাসক, সম্পদশালী ব্যক্তি যে তার সম্পদে আল্লাহর যে অধিকার (যাকাত) তা প্রদান করে না এবং পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি। ( সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৭৫৯)
যারা যাকাত দিতে টালবাহানা করে বা তা দিতে বিরত থাকে ও দ্বিধা করে তাদের হাদিসে অভিশপ্ত বা মালাউন বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন: اكل الربا وموكوله و كاتبه وشاهده اذا علموا به والواشمة والمستوشمة للحسن ولاوي الصدقة والمرتد اعربيا بعد هجرة ملعونون على لسان محمد صلى الله عليه وسلم يوم القيامة – “সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, সুদের লেখক, সুদের সাক্ষীদ্বয়- যদি তা জেনে শুনে করে, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে নারী দেহে উল্কা কাটে বা অন্যের দেহে উল্কা কেটে দেয়, যাকাত প্রদানে যে টালবাহানা করে বা বিরত থাকে এবং হিজরত করার পরে আবার যে ব্যক্তি বেদুইন (যাযাবর) জীবনে ফিরে যায় তারা সকলেই কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (স:) এর জবানীতে অভিশপ্ত মাল-ঊন। (সুনানে নাসায়ী: ৫০৪০)
যারা যাকাত না দিয়ে তা জমা করে রাখে তাদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ “আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে যে সম্পদ দান করেছেন সেই সম্পদ নিয়ে যারা কৃপনতা করে, তারা যেন কখনই মনে না করে যে, তাদের এই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণবহ বা উপকারী, বরং তা তাদের জন্য ক্ষতিকর। তাদের কৃপনতা করে সঞ্চিত সম্পদ কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী হবে। ( সূরা আল-ইমরান: ১৮০)
হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, কিছু কঠিন পাপ আছে যে গুলোর শাস্তি শুধু আখেরাতেই নয়,দুনিয়াতেও ভোগ করতে হবে। বিশেষ করে যে পাপগুলো মানুষের অধিকারের সাথে জড়িত এবং যে পাপের ফলে অন্যমানুষ কষ্ট পায় বা সমাজের ক্ষতি হয়। আর এহেন পাপ যদি সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ে তবে আল্লাহ তায়ালা সেই সমাজে গজব দেন ও সকলকে সেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (স:) বলেন: يا معشر المهاجرين، خمسٌ إذا ابتليتم بهن وأعوذ بالله أن تدركوهن: لم تظهر الفاحشة في قوم قطُّ حتى يعلنوا بها إلا فشا فيهم الطاعون والأوجاع التي لم تكن في أسلافهم الذين مضوا، ولم يُنقصوا المكيال والميزان إلا أُخذوا بالسنين وشدة المؤونة وجور السلطان عليهم، ولم يمنعوا زكاة أموالهم إلا مُنعوا القطر من السماء، ولولا البهائم لم يُمطروا، ولم ينقضوا عهد الله وعهد رسوله إلا سلط الله عليهم عدوًّا من غيرهم فأخذوا بعض ما في أيديهم، وما لم تحكم أئمتهم بكتاب الله ويتخيروا مما أنزل الله إلا جعل الله بأسهم بينهم
“হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয় থেকে বেঁচে থাক! এই পাঁচটি বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের ব্যপারে আশ্রয় প্রার্থন করছি। ১. যখন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগ-ব্যধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রসারিত ছিলনা। ২. যখন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ ওজনে কম বা ভেজাল দিতে থাকে, তখন তারা দুর্ভিক্ষ, জীবন-যাত্রায় ও প্রশাসনের বা ক্ষমতাশীলদের অত্যাচার শিকার হয়। ৩. যদি কোন সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাকাত প্রদান না করে, তাহলে তারা অনাবৃষ্টির শিকার হয়। যদি পশু-পাখি না থাকতো তাহলে তারা বৃষ্টি থেকে একেবারেই বঞ্চিত হতো। ৪. যখন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ আল্লাহ আল্লাহর রাসূলের ওয়াদা বা আল্লাহর নামে প্রদত্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের কোন বিজাতীয় শত্রুকে তাদের উপর ক্ষমতাবান করে দেন, যারা তাদের কিছূ সম্পদ নিয়ে যায়। ৫. আর যদি কোন সম্প্রদায়ের শাসকবর্গ ও নেতাগণ আল্লাহর কিতাব ( পবিত্র কুরআন) অনুযায়ী বিচার শাসন না করেন এবং আল্লাহর বিধানের সঠিক ও ন্যায়ানুগ প্রয়োগের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা না করে, তখন আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পর শত্রুতা ও মতবিরোধ সৃষ্টি করে দেন,তারা তাদের বিরত্ব একে অপরকে দেখাতে থাকে।” ( সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪০১৭)
উপরোক্ত কুরআন ও হাদীস থেকে এই কথা প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত ইসলামের ফরজ ইবাদত গুলো অন্যতম ফরজ ইবাদত। যার শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে পেতে হবে। তাই সামর্থবানদের উচিৎ তার গচ্ছিত সম্পদের যাকাত যথাযথ আদায় করা। তাহলে একদিকে যেমন তার সম্পদ পবিত্র হবে তেমনি আল্লাহর ক্রোদ থেকে সে মুক্তি পাবে।
লেখক, হাফেজ, মাও: নুরুল হুদা
কুরআনিক সায়েন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবির হাট, চট্টগ্রাম।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.