সিয়াম ও তাকওয়া
দারসূল কোরআন
সিয়াম ও তাকওয়া
সূরা বাকারা: ১৮৩
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
সরল অনুবাদ:
হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতীর উপরও ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার গুনাবলী অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা:১৮৩)
পটভূমি:
নাম করন: এই সূরার নাম বাকারা বা গাভী। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭১ নং আয়াত পর্যন্ত বনী ইসরাইল জাতি তাদের মধ্যকার একজন হত্যাকারী নির্ধারণে যে গাভীর ঘটনা ঘটেছে সেই ঘটনার পরিপেক্ষিতেই এর নামকরণ করা হয়েছে বাকারা বা গাভী।
নাযিলের সময়কাল: এই সূরার অধিকাংশ আয়াতই রাসূল স: এর মাদানী জিন্দেগীতে নাযিল হয়েছে। তাছাড়া কিছু আয়াত প্রসঙ্গিকতার কারণে মক্কাতেও নাযিল হয়েছে। তারপরেও সর্বসম্মতভাবে এটি মাদানী সূরা হিসেবে গৃহিত হয়েছে।
বিষয় বস্তু:
সম্পূর্ণ কুরআনের একটি একটি সংক্ষিপ্ত রুপ হলো এই এই সুরা বাকারা। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার রুপরেখা, সালাত সিয়াম, যাকাত, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এতে রয়েছে মুমিন,কাফির ও মুনাফিকের সতন্ত্র পরিচয়। তাছাড়া এই সূরাতেই আলোচনা করা হয়েছে একটি নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান।
আয়াতের তাফসীর:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا – হে ঈমানদারগণ!
পবিত্র কুরআনিল কারীম যখন মুমিনদের সম্মোধন করে কোন কথা বলে তখন বুঝতে হবে এর পর আল্লাহ তায়ালা কোন বিধান, হুকুম অবতীর্ণ করতে যাচ্ছেন। আর যখন ‘নাস’ বলে সম্মোধন করে তখন বুঝতে হবে মানুষের প্রতি ঈমান গ্রহণের নির্দেশ জারি হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে মুনিনদের জন্য কেন সকল বিধানাবলী নাযিল করা হয়। এর কারণ হলো আপনি যখন নিজকে কোন একটি প্রতিষ্ঠান বা অর্গানাইজেশনের সদস্য অথবা কোন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজকে দাবী করবেন স্বভাবিকভাবে আপনার উপর সেই প্রতিষ্ঠান বা দেশের আইন আপনার উপর প্রয়োগ হবে। তাই আমি আপনি যখন নিজকে মুমিন দাবী করেছি তখন থেকেই আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলো আপনার আমার জীবন পরিচালনার জন্য নাযিল হয়।
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ তোমাদের উপর সিয়াম বিধান ফরজ করা হয়েছে।
সিয়াম কে ফরজ করা হয়েছে একথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা كُتِبَ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর কারণ হলো كُتِبَ শব্দের অর্থ লিখিত। অর্থাৎ লিখিত বিধান অবতীর্ণ করা হয়েছে। এই শব্দের মাধ্যমে আল্লাহর এই বিধান সিয়ামকে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করা হয়েছে। আর কঠিন শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মিরাছ ও কিসাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধান নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم القصاص في القتلى ওহে মুমিনগণ ! নিহতদের ব্যপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান লিখিতভাবে নাযিল করা হয়েছে। তাই বলা যায় فُرِضَ শব্দের তুলনায় كُتِبَ শব্দের ভারিত্ব ও গুরুত্ব অনেক বেশি।
كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও অনুরুপ লিখিত সিয়ামের বিধান ফরজ করা হয়েছিল।
আলোচ্য আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, সিয়াম শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীর উপরই ফরজ ছিলনা বরং তা পূর্বেকার সকল নবীর উম্মতের উপর ফরজ ছিল। ‘পূর্ববর্তীদের উপরও অনুরুপ লিখিত সিয়ামের বিধান ফরজ করা হয়েছিল’ একথাটি সংযুক্ত না হলেও সিয়াম পালন করা ফরজ করা যেতো। এর মাধ্যমে সিয়ামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এই বিধানটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সকল নবীর শরীয়তে সিয়াম পালন করা ফরজ করা হয়েছিল- আর তা এই জন্যে যে এর মাধ্যমে এমন কতগুলো গুণাবলী অর্জন হয় যা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালিন মুক্তি অপরিহায্য। শরীয়তের এমন বহু আইন রয়েছে যা এক জাতির উপর জরুরী হলেও অপর এক জাতির উপর তা পালনীয় ছিলনা। কিন্তু সিয়াম এমন একটি এবাদত যাকে আল্লাহ তায়ালা সার্বজনীন করেছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মাতের উপর সিয়াম পালন করা ফরজ করেছেন।
সিয়াম সাধনা কি? এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
ক. صوم শব্দের অর্থ বিরত থাকা। পবিত্র রমজান মাসে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামই সাওম বা রোজা। ফরজ ইবাদতগুলোর মধ্যে এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী তারবিয়াতীমূলক ইবাদত যা দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত চলবে। রাসূল স: বলেন: عليك بالصوم، فإنه لا مثل له ‘তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে, যা অন্যকোন ইবাদতের মতো নয়’। ( সুনানে নাসায়ী)
খ. সিয়ামের ফজিলত:
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এ পবিত্র মাসে নিজেদের আল্লাহর ইবাদতে নিজেদের মগ্ন রাখেন যাতে করে তারা আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাযাত পেতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেও এই মাসে তার সকল রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন।
রাসূল স: বলেন:
إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت أبواب النار وصفدت الشياطي ‘ যখন রমাজান আগমন করে তখন জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তান করা হয় শৃংখলিত। (মুসলিম)। তাছাড়া রমাজান মাসকে আল্লাহর রাসূল রোজাদারের জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
তিনি বলেন:
الصيام جُنّة من النار، كجنّة أحدكم من القتال রোজা হলো জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ঢাল, যেমন যুদ্ধের ময়দানে তোমাদের কেউ ঢাল ব্যবহার করে। (ইবনে মাজাহ)। আমরা যতগুলো ইবাদত করি তার প্রতিটি ইবাদতই আমাদের নিজেদের জন্য কিন্তু সিয়াম একামাত্র আল্লাহর জন্য। কারণ এতে লোক দেখানোর কিছুই নেই। রাসূল স: ইরশাদ করেন:
قال الله عزوجل: كل عمل بن آدم له إلا الصيام؛ فإنه لي وأنا أجزي به، والصيام جنّة ‘ হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতয়ালা বলেন: বনী আদমের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য শুধুমাত্র রোজা ছাড়া। আর নিশ্চয়ই রোজা আমার জন্য আমি নিজেই এর প্রতিদান দান করবো। আর রোজা হলো ঢাল স্বরুপ। (বুখারী ও মুসলিম)। অপর দিকে সারাদিন রোজা রাখার দরুণ রোজাদারের মুখ থেকে যে দুর্গন্ধ বের হয় তাকে মেশকের ঘ্রাণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রাসূল স: বলেন:
والذي نفس محمد بيده لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك ‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহ তায়ালার নিকট মেশকের সূগন্ধির চাইতেও অধিক প্রিয়। (বুখারী ও মুসলিম)। রোজা রাখার একজন ব্যক্তি যেভাবে আনন্দিত হয় অন্য কোন ইবাদতের মাধ্যমে হয়না। হাদিসে এসেছে:
للصائم فرحتان يفرحهما: إذا أفطر فرح، وإذا لقي ربه فرح بصومه ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি হলো যখন সে ইফতার করে। অপরটি হলো সে যখন তার রোজার পুরুস্কারের জন্য আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে (বুখারী ও মুসলিম)।
কোন রোজাদার যদি পূর্ণ একাগ্রতার সাথে রোজা পালন করে আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বেরকার সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। রাসূল স: ইরশাদ করেন:
من صام رمضان إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে সিয়াম সাধনা করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে (বুখারী ও মুসলিম)।
দোয়া কবুলের মাস বলা হয় রমজান মাসকে। রাসূল স: বলেন:
ثلاث دعوات لا ترد: دعوة الوالد، ودعوة الصائم، ودعوة المسافر ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, পিতা-মাতা,রোজাদার ও মুসাফিরের দোয়া (বায়হাকী)
রোজাদারের জন্য আরো সম্মানের বিষয় হলো তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের আলাদা দরজা থাকবে। রাসূল স: বলেন:
في الجنّة ثمانية أبواب، فيها باب يُسمى الريّان، لا يدخله إلا الصائمون ‘জান্নাতে আটটি দরজা থাকবে, তার মধ্যে একটি দরজার নাম “রাইয়ান”। সেই দরজা দিয়ে শুধুমাত্র রোজদারগণই প্রবেশ করবে ( বুখারী)।
কঠিন কিয়ামতের মাঠে যখন মানুষ তার নাজাতের জন্য বিভিন্ন উসিলা ও সুপারিশকারী খুঁজবে তখন সেই কঠিন মুহুর্তে রোজা মানুষের জন্য আল্লহর নিকট সুপারিশ করবে।
রাসূল স: বলেন: الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام: أي رب، منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه، ويقول القرآن: منعته النوم بالليل، فشفعني فيه، فيشفعان ‘ কিয়ামতের দিন সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত রেখেছি,সুতরাং তার ক্ষেত্রে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুরআন বলবে, আমি রাতে তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ক্ষেত্রে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। তখন তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
রমজান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সহানুভূতির অনুভূমি জাগ্রত হয়। ক্ষুধার তীব্রজ্বালা, অভাবী মানুষের খাবারের নিদারুন যাতনা তা রোজাদারের মধ্যে অনুভূত হয়। আর এমন কষ্ট স্বীকার করার মূল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত অনাচার-পাপাচার থেকে নিজকে বিরত রাখা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা। তাই রোজাদের উচিৎ সকল প্রকার অন্যায় আচারণ থেকে নিজকে বিরত রাখা। রাসূল স: বলেন: من لم يدع قول الزور والعمل به، فليس لله حاجة في أن يدع طعامه وشرابه ‘যে ব্যক্তি খারাপ কথা ও মন্দ কাজ ছাড়তে পারলোনা, তার খাবার পানীয় ত্যাগ করা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই( বুখারী)
সিয়াম ও কুরআন:
এই মাসের প্রতিটি মুহুর্তই অতিব গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসেই আল্লাহ তায়ালা মানব জাতীর হেদায়েতের বাণী আল কুরআন নাযিল করেন। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:
إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ، وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ، لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬، تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيہَا بِإِذۡنِ رَبِّہِم مِّن كُلِّ أَمۡرٍ۬، سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ
‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাত্রিতে। আর আপনি কি জানেন কদরের রাতটা কি?, কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও বেশি উত্তম। সে রাতে ফেরেশতা ও রুহ তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এই রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। (সুরা কদর:১-৫)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে’।
কদরের রজনীতে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য বনী আদমকে মাপ করে দেন। তাই যে কদরের দুর্লভ রজনীর অনুসন্ধান যারা হারালো তারা যেন দুনিয়ার সবকিছূই হারালো।
لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ : আসা করা যায় সিয়াম পালনের মাধ্যমে তোমরা তাকওয়ার গুন অর্জন করতে পার।
আয়াতের শেষে তাকওয়া অর্জনকে সিয়ামের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থীর করা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নায় এই তাকওয়াকে খুব গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। একজন মুমিনের ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে তাকওয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ্ই কারণে বলা হয় প্রতিটি ইবাদতের প্রাণ হলো তাকওয়া। প্রাণহীণ দেহ যেমন মূল্যহীন তেমনি তাকওয়াবিহীন ইবাদতও মূল্যহীন।
তাকওয়া শব্দটি আরবী وقي মূলধাতু থেকে নেওয়া হয়েছে্। যার অর্থ বেঁচে থাকা,ভয় করা,সাবধান হওয়া। তাকওয়া বলতে আল্লাহ ভীতিকে বুঝায়। তাই আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার নামই তাকওয়া। যারা নিজের জীবনে তাকওয়ার গুনাবলীর সমাহার ঘটেছে সেই মুত্তাকী। পবিত্র কোরআন মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য আলোচনা দিয়ে আল-কুরআনের সূচনা করেছে। আল্লাহ বলেন:
ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ، الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ، والَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ، ‘এই কিতাবটি সেই কিতাব যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং মুত্তাকীদের জন্য এই কিতাব হেদায়াতের হাতিয়ার। আর তাকওয়ার অধিকারী তারা যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে গায়েবের উপর, যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক থেকে ব্যয় করে, পূর্বের কিতাবসমূহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে’।(সূরা বাকারা: ২-৪)
মুমিন জীবনের সফলতাও তাকওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। কোরআন বলছে- وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ “আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য জীবন চলার পথ বের করে দেন আর ধারণার অতীত জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন”। (সুরা তালাক: ২-৪)
আর আল্লাহর নিকট বান্দার সম্মান, মর্যাদার তারতম্য তাকওয়ার মানদন্ডেই বিবেচিত হয়। কোরআনে বলছে- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই সম্মানিত যে অধিক তাকওয়াবান, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শুনেন ও খবর রাখেন। ( সুরা হুজুরাত:১৩)।
তাকওয়া ও সিয়াম: তাকওয়া কোন ভালো গুনের নাম নয় বরং তা অসংখ্যা গুনের সমাহার। মনে হয় শত শত উন্নত নৈতিক গুনাবলী তাকওয়ার জঠরে জন্ম নেয়। কুরআনে কারীম এই গুণাবলী অর্জনে সিয়াম সাধনাকে জরুরী করেছে। এটি বান্দার জন্য খোদা তায়ালার পক্ষ্য থেকে প্রশিক্ষণ। এই তাকওয়ার মাধ্যমেই প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মানব হৃদয়ের উপরও তাকওয়ার প্রভাব অনন্য। পাপাচার ও সীমালংঘনের রয়েছে অসংখ্য পথ। তার মধ্যে তিনটি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে মানুষের বাড়াবাড়ি যেন খুলে দিয়েছে গুনাহের হাজার বন্ধ দরজা। আর তা হলো:
প্রথমত: মানুষের জীবন ধারণের জন্য ‘খাদ্য ও পানীয়’ অপরিহার্য প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যদি মানুষেরা একান্ত প্রয়োজনের উপর সন্তষ্ট না হয়ে আরও উন্নত খাদ্য ও পানীয় চায় তবে সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য হবে। আর এর নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন তাকওয়া। তা নাহলে সে তার সীমাহীন চাহিদা পূরণে অবাধ্য পথ বেছে নেবে।
দ্বিতীয়ত:মানুষের জীবনে এবং সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে স্বীয় বংশ বিস্তারের এক জরুরী প্রয়োজন লুকায়িত রয়েছে। এই জন্যই শ্রষ্টা নারী-পুরুষের মধ্যে দৈহিক মিলনের ও যৌন ক্ষুধা নিবারণের প্রয়োজনীয়তা বলবৎ করে দিয়েছেন। আর এটি নিবারণের জন্য রয়েছে শ্রষ্টারই বেঁধে দেওয়া বিশেষ নিয়ম। যাকে বলা হয় বিবাহ বন্ধন।
আফসোস করে বলতে হয় অন্য সকল সৃষ্টিকুল আল্লাহর দেওয়া এই বিধান মেনে নিলেও আশরাফুল মাখলুকাত বিষয়ে নৈতিকতার সীমানা ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। দেশের সর্বচ্ছো পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাস্তায় বাস করা টোকাই আজ বিকৃত মানসিকতার যৌন রোগে আক্রান্ত।
পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, ইন্টারনেটে প্রতিদিন খবর আসছে পুরুষে-পুরুষে, নারীতে-নারীতে, একজন পুরুষ অথবা একজন নারী কিভাবে কুকুর সাথে যৌন মিলন করছে। যা ভাবতেও লোম শিওরে ওঠে। আর সিয়াম এই সমস্ত বিকৃত কাজ থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মনে তাকওয়া সৃষ্টি করে তা থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত করে তোলে। এই কারণে রাসূলে আকরাম স: ইরশাদ করেন: يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ ‘ হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ রাখে তারা যেন বিবাহ করে নেয়। কারণ এটি তার দৃষ্টি অবনত করতে সহায়তা করবে। আর যে বিবাহ করতে অক্ষম সে যেন রোজা রাখে। কারণ তা তার জন্য যৌন কামনা দমনকারী।
তৃতীয়: মানুষের জীবন-যাপনে আরাম ও আয়েশের প্রতি রয়েছে চরম দূর্বলতা। আর তাই মানুষ তার আরাম আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে জীবন অতিবাহিত করার জন্য নানা পথ বেছে নেয়। আর তখনই মানুষ এসব চাহিদা পূরণে অন্যায় পথে পা বাড়ায়। এ সকল অন্যায় পথ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে একমাত্র ‘তাকওয়া’। সিয়ামও সেই ধরণের খোদাভীতিই সৃষ্টি করে। সিয়াম পালন কারীগণ রাতে ক্লান্ত দেহে দীর্ঘক্ষণ তারাবীর সালাত আদায় করে আবার শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও সেহরীর জন্য উঠতে হয়। যা অতিরিক্ত আরামে বাধা সৃষ্টি করে। মানুষের আরামের লোভ দমন করতে শেখায়।
শিক্ষাণীয় দিক:
১. যারা আল্লাহ তায়ালা আনুগত্যে করতে প্রস্তুত আল্লাহ তায়ালা তাদের উপরই তার বিধান জারী করেন।
২. মুমিনতো তারাই যারা ভালোবাসা ও ভয় নিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে।
৩. সিয়াম কুরআন নাযিলের মাস। তাই এই মাসে নিজেকে কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
৪. সিয়ামের বিধান সকল যুগে সকল উম্মতের উপর ফরজ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নৈতিকতার উন্নত শিখরে আরোহন করতে পারে।
৫. তাকওয়া অর্জন করাই সিয়ামের মূল লক্ষ্য
৬. যে সিয়াম পালন করলো অথচ পাপাচার-অনাচার থেকে বিরত থাকেনি তার সিয়াম গ্রহণযোগ্য নয়।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.