উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা ছাড়া ঈমান মূল্যহীন
চরিত্র নিয়ে হাদিস ও উত্তম চরিত্র সম্পর্কে কুরআনের আয়াত
হযরত আবু দারদা রা: হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সা: বলেছেন, “কিয়ামতের দিন মুমিন বান্দার দাঁড়িপাল্লায় উত্তম চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস আর কিছুই হবে না। আর যে ব্যক্তি বেহুদা, অশ্লীল ও নিকৃষ্ট ধরনের কথাবার্তা বলে, আল্লাহ তাআলা তাকে মোটেই পছন্দ করেন না।” (তিরমিজি)
উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা
উত্তম ও নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। প্রিয়নবী করিম সা: ঈমানের পর নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। নৈতিক চরিত্র ছাড়া ঈমান মূল্যহীন। উত্তম ও নৈতিক চরিত্র মানুষের সঠিক কল্যাণের উৎস। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র সর্বোত্তম। অপর একটি হাদিসে এসেছে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলো সেই যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।” (বুখারি ও মুসলিম)
রাসূলে কারীম সা:-এর আগমনের উদ্দেশ্যের একটি প্রধান কারণ হলো ‘তাজকিয়াতুন নাস’ অর্থাৎ মানুষের মন-মগজ, চরিত্র ও কার্যাবলিকে নির্মল, পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন ও নিষ্কলুষ করে তোলা এবং সর্বপ্রকার ক্লেদ মলিনতা হতে মুক্ত করা। কেননা মানুষের বৈশিষ্ট্য স্বীকৃত ও প্রমাণিত হতে পারে উত্তম নৈতিক চরিত্রের বদৌলতে। স্বয়ং রাসূল সা: তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, “উত্তম নৈতিক চরিত্রের পরিপূর্ণতার জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।” (বায়হাকি, মুসনাদে বাযযার)
নৈতিক চরিত্র প্রতিষ্ঠায় রাসুলের আগমন
গোটা মুসলিম উম্মাহ তথা মানবজাতির চরিত্রের মডেল হলেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর সততা, নৈতিকতা ও চরিত্র প্রেরণা জোগায়। আদর্শ শাসক থেকে শুরু করে আদর্শ পিতা, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, চৌকস সেনাপতি, কর্মনিষ্ঠ শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের চরিত্রের দর্পণ তিনি। তাঁর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, “(হে নবী!) নিশ্চয় আপনি মহান ও উন্নত চরিত্রের ওপরে অধিষ্ঠিত।” (সূরা আল ক্বালাম, আয়াত : ৪) অপর এক আয়াতে মহান রব মানবজাতিকে উদ্দেশ করে বলেন,“অবশ্যই রাসূল সা:-এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” (সূরা আল আহজাব, আয়াত ২১)
প্রিয়নবী সা: উন্নত নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন, কেননা ঈমানের পূর্ণতা উন্নত নৈতিক চরিত্রের ওপরই নির্ভরশীল। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে যে যতদূর উন্নত, তার ঈমান ততদূর পরিপূর্ণ। অন্য কথায়, উন্নত নৈতিক চরিত্র পূর্ণ ঈমানের অনিবার্য ফল বিশেষ। অতএব যার ঈমান যত কামেল, তার চরিত্রও তত উন্নত হবে এবং যার চরিত্র উন্নত, মনে করতে হবে যে, সে একজন ‘মুমিনে কামেল’ তথা পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার ব্যক্তি। রাসূলের হাদিসে প্রতীয়মান হয়, “মুমিনদের মধ্যে সর্বাধিক পূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি যার নৈতিক চরিত্র তাদের মাঝে সর্বোত্তম।” (তিরমিজি)
আমাদের কেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে
দরসে আবু দারদা রা: হতে বর্ণিত হাদিসে উত্তম চরিত্রের পরকালীন ফলাফল ও পুরস্কার সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিয়ামতের দিন ঈমানদার ব্যক্তির আমলনামা যখন ওজন করা হবে তখন উত্তম চরিত্রই ওজনের পাল্লায় ভারী জিনিসরূপে প্রমাণিত হবে। এই উত্তম চরিত্রই তার নাজাতের ওসিলা হিসেবে কাজ করবে। তার অর্থ, ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই দুনিয়ায় অতি উত্তম চরিত্রবান হবে। কেননা ঈমান ও উত্তম নৈতিক চরিত্রের মধ্যে গভীর সম্পর্ক নিহিত। উক্ত হাদিসে মন্দ ও খারাপ চরিত্রের একটি বিশেষ গুরুতর দিক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে, অশ্লীল কথা বলা এবং বেহুদা, বাজে ও নীচ-হীন কথাবার্তা বলা। কথা মানুষের মনোভাব ও চিন্তাধারার বাহন।
মানুষের অন্তরের ভাবধারাও অভ্যন্তরীণ প্রকৃতরূপের প্রকাশ ঘটে মুখের ভাষায়। এ জন্য রাসূল সা: মানবিক চরিত্র উন্নয়নের জন্য সবরকমের অশ্লীল কথাবার্তা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি (সা:) ঘোষণা করেছেন যে, যারা এ জাতীয় চরিত্রের অধিকারী আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে একবিন্দু ভালোবাসেন না। সাথে সাথে তাদের প্রতি মহান রবের অপরিসীম ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি পতিত হয়। যাদের প্রতি মহান আল্লাহর ক্রোধ থাকে তাদের ভবিষ্যৎ কখনো কল্যাণময় হতে পারে না। এ ছাড়াও তাদের অসৎ চরিত্র বিচারের পাল্লাকে হালকা করে দেবে যা তাদের জন্য অত্যন্ত আফসোসের কারণ হবে।
নৈতিক চরিত্র গঠনে ইসলাম
নবী করিম সা:-এর নবুয়তের মূল লক্ষ্য ছিল, মানবজীবনের সামগ্রিক দিক ও ক্ষেত্রের জন্য নৈতিক চরিত্রের অপূর্ব ও উজ্জ্বল নিদর্শন সংস্থাপন করা। মূলত দ্বীন ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি (সা:) যত কাজই করেছেন, যত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারই করেছেন, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল লোকদের সম্মুখে চূড়ান্তভাবে নৈতিক চরিত্রের মাহাত্ম্য উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করে তোলা। ব্যক্তিমানুষকে নৈতিক চরিত্রের ভিত্তিতে গঠন করা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিতে গড়ে তোলা। আর এর জন্য ইসলামী জীবনব্যবস্থাই যে একমাত্র কার্যকর ও চূড়ান্ত বিধান তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকতে পারে না। এ জন্য যখন আয়েশা রা:-কে রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন তিনি (রা:) বলেছিলেন, “রাসূলের চরিত্র ছিল আল-কুরআন”।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিগণ কিয়ামতের দিন রাসূল সা:-এর প্রিয়পাত্র হিসেবে গণ্য হবেন এবং বিশেষ মর্যাদা লাভ করবেন। বিপরীতে অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিগণ রাসূল সা:-এর কাছে ঘৃণার পাত্র হবে। হজরত যাবের রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল করিম সা: বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে আমার নিকট অধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে অধিক নিকটবর্তী হবে সেই সকল মানুষ, যারা আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।
মুখের ভাষা হতে হবে সুন্দর ও সত্য
তোমাদের মধ্যে আমার কাছে অধিকতর ঘৃণিত এবং কিয়ামতের দিন আমার থেকে অধিক দূরে থাকবে তারা, যারা কথা বলার সময় কৃত্রিমতা ও কপটতার আশ্রয় নেয় এবং দ্রুত ও লম্বা লম্বা কথা বলে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে এবং কথার মাধ্যমে নিজের বাহাদুরি প্রকাশ করে এবং অহঙ্কার পোষণ করে। (তিরমিজি)
উপরোক্ত হাদিসটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে অনেক মুসলিম নামধারী শাসক বা শাসনকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ এ জাতীয় চরিত্রের অধিকারী। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে যেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি মিডিয়ার সামনে এলে অনর্গল মিথ্যাচার করে থাকে। কথার মাধ্যমে তাদের বাহাদুরি প্রকাশ করে। ভাবখানা এমন, যেন দুনিয়ার কাউকে তারা পরোয়া করে না। নিজের প্রশংসা নিজে করে এবং অন্যদের মানমর্যাদা ক্ষুণ্য করার ব্যাপারে সদা তৎপর থাকে। কথার মাধ্যমে নিজের অহঙ্কার প্রকাশ করে।
রাসূল সা: উত্তম চরিত্রওয়ালা মুমিনের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হযরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, “নিশ্চয় ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর উত্তম চরিত্রের সাহায্যে সেসব লোকের ন্যায় সম্মান ও মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত জেগে নফল নামাজ পড়ে এবং দিনের বেলা রোজা পালন করে।” (আবু দাউদ)
অপর একটি হাদিসে উত্তম চরিত্রকে পুণ্য হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। নাওয়াস ইবনে সাময়ান আনসারী রা: বলেন, আমি একদা রাসূল সা:-কে পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে তিনি (সা:) বললেন, “পুণ্য হচ্ছে উত্তম চরিত্র আর পাপ হলো যা তোমার মনে কুণ্ঠা জাগায় এবং লোকেরা তা জানতে পারুক তা তুমি পছন্দ কর না।” (মুসলিম)
দায়ীদের হতে হবে উত্তম চরিত্রের অধিকারী
ইসলাম প্রচারকাজে নিয়োজিত দায়ীদের অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। চরিত্রবান দায়ীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয় এবং তাদের কথার মাধ্যমে দাওয়াতের সম্প্রসারণ হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “(হে নবী!) হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আপনি মানুষকে আপনার রবের পথে ডাকুন। আর তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করতে হলে সুন্দরভাবে করুন।” (সূরা আন নাহল, আয়াত : ১২৫)
একজন দায়ীকে কতিপয় মৌলিক চরিত্র বা গুণাবলি অর্জন করতে হবে। যেমনÑ ইখলাস ও নিষ্ঠা, উন্নত আমল ও নৈতিকতা এবং সত্য প্রকাশে অকুতোভয়। এভাবে আমল ও চরিত্রের মশাল দিয়ে বাতিল শক্তিকে বিকল করে দিতে হবে।
অনুরূপভাবে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের কর্মীদের চরিত্র হবে সাহসী চরিত্র ও যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে ধৈর্যধারণের হিম্মত রাখবে।
হাদিসে এসেছে, হযরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মানুষের ওপর এমন এক সময় আসবে যখন দ্বীন ইসলামের ওপর যে ব্যক্তি ধৈর্যের সাথে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকবে তখন তার অবস্থা হবে হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার ধারণকারীর মত।” (তিরমিজি)
প্রত্যেক মুমিনের উচিত হলো মহানবী সা: ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের অনুকরণের মাধ্যমে উন্নত নৈতিক চরিত্র অর্জন করা। চরিত্রের উন্নয়ন ছাড়া একজন মানুষ যেমন পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, তেমনি উত্তম নৈতিক চরিত্র ছাড়া একজন শাসক ন্যায়পরায়ণ হতে পারবে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে কামিয়াব হতে গেলে উত্তম চরিত্র আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে একজন দায়ী ও সংগঠকের দ্বীন প্রচার ও প্রসারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো উত্তম, উন্নত চরিত্র ও আদর্শ।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.