কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইসলামের অবদান
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সামাজিক সুবিচার
ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। ইসলাম দায়িত্বহীনতা, অশ্রদ্ধা, কপটতা, অন্যায়-জুলুম, নিপীড়ন, অবিচার, স্বার্থপরতা, অসততা, বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতাকে পদদলিত করে মানবসমাজে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ, মর্যাদাবোধ, নিষ্ঠা, সততা, সুবিচার, সহানুভূতি, কল্যাণ কামনা, দয়া-মায়া এবং দরদ-ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। মূলত ইসলামের মূল শিক্ষাই হচ্ছে অকল্যাণের পথ চিরতরে বন্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র উপহার দেয়া।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা :
কল্যাণকামিতাই ইসলাম। অন্ধকার যুগের ইতিহাসকে মুছে দিয়ে পৃথিবীর বুকে কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার যে অধ্যায় মহানবী সা: শুরু করেছেন আজকের পৃথিবীতে তার আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। নিঃশেষ হয়নি তার বিমল আদর্শের প্রয়োজনীয়তা। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে তা কখনো হবেও না। সে জন্যই ইসলাম স্বীকৃতি পেয়েছে একটি সর্বকালীন ও সার্বজনীন ধর্ম বা বিধান হিসেবে।
ইসলাম কী? ইসলামের মর্মবাণী হলো অকল্যাণের পথ বন্ধ করে শান্তি, সাম্য ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে এবং মানুষে মানুষে শান্তি স্থাপন ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইহজাগতিক শান্তির মধ্য দিয়ে পরকালীন শান্তি তথা মুক্তির লক্ষ্য উপনীত হওয়ার চেষ্টার মধ্যেই ইসলামের সুর ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত।
ইসলাম শব্দটি উদ্ভব হয়েছে ‘সলম’ থেকে। ‘সলম’ অর্থ শান্তি। সে হিসেবে ইসলাম বলতে বোঝায় উচ্চতম আদর্শের কাছে পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসর্ম্পণ। ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি অর্জন ইসলামের একমাত্র লক্ষ্য নয়। নিজের শান্তি অর্জনের পাশাপাশি জনগণের সামাজিক ও বৈষয়িক জীবনের শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের অভীষ্ট লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন বিবদমান শক্তির মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিসত্তাকে তার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সাহায্যে আত্মশৃঙ্খলা অর্জনই ইসলাম।
অকল্যাণের সব পথ বন্ধ করে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। ইসলাম এমন এক ব্যাপক ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তি স্থাপন করেছে যেখানে জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা সামাজিক পেশা ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে সব নর-নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একজন অন্যজনের অধিকারকে পদদলিত করতে পারে না।
কল্যাণময় বিশ্ব
আল কুরআন সব মানুষের সার্বিক দিক ও বিভাগের সমন্বিত একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শন। কল্যাণময় বিশ্ব বিনির্মাণে কুরআন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে সবাইকে। যেমন-
ক, ইসলাম বিশ্বমানবতার ধর্ম। সর্বত্র কল্যাণ স্থাপনের লক্ষ্য ইসলাম তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছে। কল্যাণময় পরিবেশ সৃষ্টির পর সেখানে অকল্যাণের প্রচেষ্টাকে চরমভাবে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আরাফ : ৫৬)।
খ, অকল্যাণকারী সবার কাছেই ঘৃণিত। মহান আল্লাহ এদের ঘৃণার চোখে দেখে তাদের ওপর লানত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকার আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লানত এবং মন্দ আবাস।’ (সূরা রাদ : ২৫)।
গ, অকল্যাণকারী আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত। অকল্যাণে লিপ্ত থাকার দরুন যারা আল্লাহর কোপানলে নিপতিত হয়েছে তাদের কথা উল্লেখ করে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এবং তারা সেথায় অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল। অতঃপর তোমার প্রতিপালক তাদের ওপর শাস্তির কশাঘাত হানলেন।’ (সূরা ফাজর : ১২-১৩)।
ঘ, অকল্যাণকারী অকল্যাণ সৃষ্টি করেও নিজেদের সমাজে শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের যখন বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না; তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী।’ (সূরা বাকারা : ১১)।
ঙ, পৃথিবীর বুকে অকল্যাণময় কর্মকাণ্ড পরিহার এবং উদ্ধতভাবে চলাফেরা হতে যারা নিজেদের বিরত রেখেছে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। আল্লাহ বলেন, ‘এটি আখেরাতের সে আবাস, যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য।’ (আল কুরআন)।
চ, দেশ ও সমাজে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ পরোপকারের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পৃথিবীর বুকে অকল্যাণ সৃষ্টি না করার জন্য বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পরোপকার করো যেমন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় (অকল্যাণ) সৃষ্টি করতে চেও না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।’ (সূরা কাসাস : ৭৭)।
ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা :
মহানবী সা: প্রেরিত হয়েছিলেন সারা জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। তাই পার্থিব জীবনে সব মানুষ যেন সুখে শান্তিতে বাস করতে পারে, শান্ত-স্নিগ্ধ এ পৃথিবীতে বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। কিছু দুর্বৃত্ত দুরাচারের জন্য সমাজের সব শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন যাতে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য তিনি ছিলেন সর্বদাই সচেতন।
এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন কার্যকর পদপে গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তিনি প্রয়োজনে কল্পনাতীত ভাবে কঠোর হয়েছেন। দুনিয়া থেকে যত অনাচার, অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাস, অকল্যাণ সবই তিনি কঠোর থেকে কঠোরতরভাবে প্রতিরোধ করেছেন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘হত্যাকারীর ফরজ, নফল কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।’ (তিরমিজি)। অন্যত্র বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষের মধ্যে হত্যা সম্বন্ধে বিচার করা হবে।’ (বুখারি, মুসলিম)।
কাফেরদের অত্যাচারে তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তিশৃঙ্খলা রা এবং অন্যায়ের পথ প্রতিরোধে মদিনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত ইহুদিদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে মদিনার সনদ নামে খ্যাত। সাতচল্লিশটি ধারা সংবলিত এ সনদ অন্যায়ের পথ বন্ধে এক অনন্য দলিল। যেমন এর একটি শর্তে বলা হয়েছে, তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসীদের হাত সমবেতভাবে ওইসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থিত হবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা দুর্নীতি ও ফাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে। তারা সবাই সমভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যদিও সে তাদেরই কারো আপন পুত্রও হয়ে থাকে। মহানবী সা: দয়ার সাগর হওয়া সত্ত্বেও অকল্যাণের পথ বন্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর।
লেখকঃ ড. মোহাম্মদ আতীকুর রহমান
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.