ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধরাই বিজয়ী হবে
ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধরাই বিজয়ী হবে
ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধরাই বিজয়ী হবে
আল্লাহপাকের বাণী-‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয় -ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’-সুরা নূর ৫৫
সুরা আন নূর ষষ্ঠ হিজরির শেষের দিকে আহজাব (খন্দক) যুদ্ধের কয়েক মাস পরে এবং বনু আল মুস্তালিক যুদ্ধের সময় নাজিল হয়। এই সুরায় হযরত আয়েশা রা.-এর বিরুদ্ধে ইফ্ক-এর (মিথ্যা অপবাদ) ঘটনা উল্লেখ রয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকুতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আয়েশা রা.-এর পূত- পবিত্রতার কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে মিথ্যা অপবাদের সাথে জড়িত হওয়ার জন্য মুমিনদের সতর্ক করা হয়েছে ও তাদেরকে পরস্পর সুধারণা পোষণ করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাথিদের অনুপম চরিত্র ও উন্নততর নৈতিক মানের কারণে মানুষ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল এবং এটাই স্বাভাবিক। একটি জনগোষ্ঠী উন্নততর নৈতিক চরিত্রে ভূষিত হলে আল্লাহ তাদেরকে অনেক শক্তিমানের ওপর জয়যুক্ত করে দেন। বদর, ওহুদ, আহজাবসহ কয়েকটি যুদ্ধের পর মদিনার ইহুদি ও মুনাফিকরা বুঝতে পারলো যুদ্ধ করে এ উদীয়মান শক্তিকে পরাভূত করা যাবে না। তাই তারা মুসলমানদের নৈতিক ত্রুটি তালাশ করে সেখানে আঘাত হানে। এর মধ্যে হযরত জয়নব রা. ও ইফ্কের ঘটনা অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা এসব ঘটনা উল্লেখ করে মুসলমানদের পর্দার বিধানসহ ত্রুটি সংশোধনের নানা উপায় বলে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে একটি পক্ষ (তাঁর পথে প্রচেষ্টাকারী) এবং কাফির-মুশরিকদেরকে একটি ভিন্ন পক্ষ (শয়তানের পথে প্রচেষ্টাকারী) হিসেবে আখ্যায়িত করে কাফিরদের মোকাবিলায় মুমিনদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তাঁর এই প্রতিশ্রুতির দু’টি দিক- একটি হলো ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে আখেরাতে জান্নাত প্রদান ও দুনিয়ার বিজয় অথবা শুধু আখেরাতের কল্যাণ এবং আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে সেটাই হলো সবচেয়ে বড়ো সাফল্য। জান্নাত লাভের উপযুক্ত হওয়ার জন্য আল্লাহপাক তাঁর কিতাবে নানা ভঙ্গিতে মুমিনদের গুণবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন।
এই সুরাটি যখন নাজিল হয় সে সময় মুমিনরা একটি ভূখণ্ড পেলেও সর্বক্ষণ কাফির-মুশরিক- মুনাফিকদের পক্ষ থেকে হামলা ও ভয়-ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করতেন। ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন যে, তিনি মুমিনদেরকে খেলাফত (কর্তৃত্ব) দান করবেন, দীনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ও ভয়-ভীতি দূর করে দেবেন এবং মুমিনদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি কিয়ামত পর্যন্ত বহাল রয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে মুমিনরা কেবল আল্লাহরই গোলামী (ইবাদত) করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আল্লাহর ইবাদত ও নেক আমল করা সমার্থক এবং এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সকল নেক আমলই আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে শামিল এবং এই নেক আমলের ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। ব্যক্তি ও সমাজের জন্য যা কল্যাণকর এবং মানবপ্রকৃতি আবহমান কাল থেকে যার স্বীকৃতি দিয়ে আসছে, যা আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী নয় এমন সকল আচরণ ও কাজ-কর্ম সবই আমলে সালেহ। অবশ্য এটাও ঠিক যে সুপরিচিত নেক আমলের পশ্চাতে যদি কোনো কূট-কৌশল থাকে তাহলে তা আর নেক আমল থাকে না। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো কাজ তখনই আমলে সালেহ বা নেক আমল বা ইবাদত হয় যদি তার পেছনে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা থাকে এবং এ ধরনের নেক আমলের বিনিময়ে আমলকারী দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করবে। পক্ষান্তরে একজন কাফিরের নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহ তার দুনিয়ার জীবনে বদলা দান করেন এবং পরকালে শাস্তি লঘু করে দেবেন। আল্লাহর ভাষায়-তিনি কারো আমলই বিনষ্ট করবেন না।
আমাদের সমাজে ইবাদত বা নেক আমলের ধারণা বড়ো সংকীর্ণ। নামাজ-রোজা-হজ- জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজগার বা এ জাতীয় ধর্মীয় লেবেল আঁটা কিছু আচার- অনুষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা ও খানকায় যাতায়াত ও খেদমতকেই ইবাদত বা নেক আমল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ তার ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের কোনো অনুশীলন নয়। মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করার লক্ষ্যেই মূলত আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ ফরজ করা হয়েছে। নামাজকে বলা হয়েছে আল্লাহর জিকর। মানুষ যে আল্লাহর গোলাম এ কথা বারবার (অন্তত দৈনিক পাঁচবার) স্মরণ করে দেয় নামাজ। মানুষ তার সমগ্র জীবন আল্লাহর দেয়া নিয়ম বা বিধি দ্বারা পরিচালনা করবে সেটাই ইসলামের দাবি। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ- ‘নামাজ সমাপনান্তে রুজির জন্য বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো’। আজান শুনে মুমিন ছুটে আসে জিকিরের (নামাজ) দিকে এবং শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যখন বিচরণ করে তখন আরো বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, চাকরি ও ক্ষেত-খামার যেখানেই সে দায়িত্বপালন করে সেখানেই আল্লাহর বিধানের ওপর অবিচল থাকবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বা যে পেশাই একজন মুমিন অবলম্বন করুক না কেন সে কখনই ধোকা- প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, ওজনে কম দেবে না, ভেজাল দেবে না, মিথ্যা কসম খাবে না, আমানতে খেয়ানত করবে না, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না, কাজে-কর্মে ফাঁকি দেবে না, ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নেবে না, কোনো কাজে মানুষকে হয়রানি করবে না এবং এমন চরিত্রের যে অধিকারী সেই মূলত নেক আমলকারী বা ইবাদতগুজার। নেক আমলের একটি বড়ো দিক হলো সদাচরণ। একজন ইবাদতগুজার ব্যক্তি বা নেক আমলকারী কখনই কর্কষভাষী, মেজাজী ও অহঙ্কারী হতে পারে না। সে হয় বিনয়ী, মিষ্টভাষী ও সদালাপী। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসুল সা.-এর হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে’। রসুল সা. বলেছেন- ‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’। ‘জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন’। ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম’ এবং ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। একজন মুমিন তার পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান- সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, অধীনস্থ, অনাথ-ইয়াতিম, পথিক সকলের সাথে সদাচারী। আল্লাহপাক নিজেই তাঁর নবি সম্পর্কে বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’। নেকি ও গুনাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নবি সা. বলেন- ‘নেকি হচ্ছে উত্তম চরিত্র। আর গুনাহ হচ্ছে, যা তোমার খটকা লাগে এবং মানুষ তা জানুক, এটা তোমার কাছে খারাপ মনে হয়’।
কর্ম ও আচরণে যে সৎ আল্লাহর পথে দায়ী হিসেবে কেবল তাকেই মানায়। সৎ কর্মশীল ও সদাচারী ব্যক্তি যখন মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে তখন মানুষ তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জমিনে খিলাফত দান করার ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যে তারা কেবল আল্লাহরই গোলামী করবে অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় কোনো একটি মুহূর্ত সে আল্লাহর গোলামির বাইরে যাবে না। মূলত আল্লাহর গোলামির বাইরে যে আনুগত্য তারই নাম শিরক। শিরক থেকে মুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্যভিত্তিক জীবন-যাপন করতে পারলে অবশ্যম্ভাবী আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ কখনই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। তাঁর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারীরা আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে না পারার কারণেই তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে বিলম্ব হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে চতুৃর্দিক থেকে বিপদাপদ ধেয়ে আসছে। এটা অবশ্যই একটি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষার মাধ্যমে মুমিনদের পরিশুদ্ধি, যাচাই -বাছাই ও আল্লাহনির্ভরতা বেড়ে যাবে। এমতাবস্থায় যারা ধৈর্যাবলম্বন করবে তারাই সফল হবেন। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাহদের তাঁর পথে অবিচলভাবে টিকে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক,তোহুর আহমদ হিলালী
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.