সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

জুমাতুল বিদা : রমজানের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব

মাহে রমজানের বিদায়কালীন শুক্রবার তথা শেষ জুমার দিন মুসলিম বিশ্বে জুমাতুল বিদা নামে পরিচিত। এই দিনে মুসলমানগন তাদের রমজানের সার্বিক কর্মকান্ড হিসেব করে তাদের গুনাহের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ভালো কাজগুলো কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করে। মুসলমানদের নিকট এটি একটি আত্মপর্যালোচলার দিন। বাংলাদেশ সহ  সারা বিশ্বের সকল মসজিদে মুসলমানদের এক মিলন মেলা ঘটে।

তাছাড়া এ দিবসটি মুসলমানদের নিকট আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে পরিচিত।  আর তা হলো “আল কুদুস”।

ফিলিস্তিন ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসের দখলদার ইহুদিদের হাত থেকে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানদের জাগিয়ে তোলাই এ দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়াও মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ইহুদি শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মোকাবেলার জন্য মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এ দিবস।

জেরুজালেম শহরের অপর নাম ‘কুদস’ বা ‘আল কুদস’। জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাস হলো- মুসলমানের প্রথম কেবলা। মুসলিম ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অসংখ্য নবী-রাসূলের (সা.) পদধূলিতে ধন্য এই নগরী। মিরাজ রজনীতে এই মসজিদেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সব নবীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নামাজের ইমামতি করেছিলেন। হজরত সোলায়মান (আ.) সর্বপ্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। অসংখ্য নবী-রাসূলের দাওয়াতি মিশন পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে।

জেরুজালেম নগরী বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান। সব ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই নগরীকে শ্রদ্ধা করে থাকেন। কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে, বায়তুল মোকাদ্দাস ও জেরুজালেম নগরীতে আজ মুসলমানদের বিচরণ নিষিদ্ধ। নিজেদের পবিত্র স্থানে যেতে তারা আজ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সেখানে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত। ইহুদিরা জবরদখল করে আছে সেখানে। বছরের পর বছর ধরে মুসলমানরা সেখানে যেতে পারছে না। হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত এই নগরীতে মুসলমানরা আজ নিগৃহীত। শুধু ফিলিস্তিনবাসীর জন্য নয়, সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।

জুমাতুল বিদা ও আত্মপর্যালোচনা:

“জুমাতুল বিদা” উপস্থিত মানেই হলো রমজানের বিদায় ঘন্টা বেজে উঠা। রমজান নামক মেহমান আমাদের থেকে বিদায়ের সময় আসন্ন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা রমজানের উদ্দেশ্যের বিষয়টি উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেন:

يأيها الذين ءامنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون  

“ ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছে তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো”। (সূরা বাকারা: ১৮৩)

রাসূলুল্লাহ স: ইরশাদ করেন

من صام رمضان إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه، ومن قام ليلة القدر إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه

অর্থ: যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)

রাসূল স: আরো বলেন:

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين، ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة، فلم يغلق منها باب، وينادي مناد: يا باغي الخير أقبل، ويا باغي الشر أقصر، ولله عتقاء من النار، وذلك كل ليلة:

“যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর  হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো। আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে”। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।

বিশেষভাবে আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ স: রমজানের শেষ দশদিনের ফজিলতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। পবিত্র কুরআনে এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করে আল্লাহ তায়ালা একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ * وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ * لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ * تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ * سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

“নিশ্চিয়ই আমি একে ( কুরআনকে) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। ( হে রাসূল) আপনি কি জানেন, কদরের রাত্রি কি? – কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো।- ফেরেশতারা ও রূহ (জীব্রাঈল আ:) এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত” ( সূরা কদর: ১-৫)

অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ইরশাদ করেন:

إنا أنزلناه في ليلة مباركة إنا كنا منذرين فيها يفرق كل أمر حكيم

“ নিশ্চয়ই আমি তা ( কুরআন) নাযিল করেছি এক মোবারকময় রাত্রিতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়” (সূরা দুখান: ৩-৪)।

রাসূলুল্লাহ স: ইরশাদ করেন: مَن قام ليلة القدر إيمانًا واحتسابًا، غُفر له ما تقدَّم من ذنبه “ যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে কদরের রাত্রিতে কিয়ামুল্লাইল (নফল সালাত) আদায় করবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ( সহীহ বুখারী:১৮০২)

উল্লেখিত কুরআন ও হাদীসের প্রতি লক্ষ করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব অত্যাধিক। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি রমজানের এই মহত্ব হাসিল করতে পেরেছি? যদি পেরে থাকি তবে আল্লাহর নিকট আমাদের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করতে হবে। আর যদি না পারি তবে অবশ্যই আমরা হযরত জীব্রাঈল আ: ও রাসূলুল্লাহ স: এর লানতের উপযোগী হয়েছি। হয়েছি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। হাদিসে এসেছে:

أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ ، فَقَالَ : آمِينَ ، آمِينَ ، آمِينَ ” ، قِيلَ لَهُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، مَا كُنْتَ تَصْنَعُ هَذَا ؟ فَقَالَ : قَالَ لِي جِبْرِيلُ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا لَمْ يُدْخِلْهُ الْجَنَّةَ ، قُلْتُ : آمِينَ ، ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ ، فَقُلْتُ : آمِينَ ، ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ امْرِئٍ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ ، فَقُلْتُ : آمِينَ

একদিন রাসূলুল্লাহ স: মিম্বারে উঠলেন, অতপর তিনি বললেন: আমীন! আমীন! আমীন! তাঁকে প্রশ্ন করা হলো (ইয়া রাসূলুল্লাহ) আপনার কি হয়েছে? তিনি বললেন: আমার নিকট জীব্রাঈল এসে বলেছে: তার চেহারা ‍ধুলায় মলিন হোক যে তার পিতা-মাতা দু’জনকে অথবা দু’জনের একজনকে পেয়েছেন কিন্তু সে ( তাদের সেবা করে) তার জান্নাত নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি বলেছি আমীন। অতপর তিনি বললেন: তার চেহারা ‍ধুলায় মলিন হোক যার নিকট রমজান আসল অথচ সে তার গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি।আমি বলেছি আমীন। অতপর তিনি বললেন: তার চেহারা ‍ধুলায় মলিন হোক যার নিকট আপনার নাম উল্লেখ করা  হয়েছে অথচ সে আপনার উপর দরুদ পড়েনি। আমি বললাম আমীন। ( আদাবুল মুফরাদ: ৬৪২)

বাকী রমজানে করনীয়:

বেশি বেমি ক্ষমা প্রার্থনা করা:

প্রিয় রোজাদার ভাই-বোনেরা! যেহেতু রমজান একেবারে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে, এখন আর বড় কোন পরিকল্পনা করার সুযোগ নেই। এখন সময় হলো ঘরে ফসল তোলার মতো নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নেওয়া। সম্পাদিত কাজগুলো কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা। সম্ভব হলে ইতেকাফ করা। কারণ ইতেকাফ হলো আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য পাওয়ার এক সুবর্ণ ‍সুযোগ। তাছাড়া বেশি বেশি কিয়ামুল্লাইল তথা তাহাজ্জুদ আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

“ বলুন, হে আমার বান্দাগন! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সমস্ত গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা যুমার: ৫৩) । সুতরাং বাকি দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করা। নিজের গুনাহের স্বীকৃতি দেওয়া, আর গুনাহ না করার ওয়াদা করা।

ঈদের পূর্বে করনীয়:

ঈদের সালাতের পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা অন্যতম সওয়াবের কাজ। হাদীসে এসেছে:

عن ابن عباس – رضي الله عنهما – قال: ” فرض رسول الله – صلى الله عليه وسلم – زكاة الفطر طهرة للصائم من اللغو والرفث وطعمة للمساكين من أداها قبل الصلاة فهي زكاة مقبولة , ومن أداها بعد الصلاة فهي صدقة من الصدقات

“হযরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ স: সাদাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন,যেন সিয়াম পালন কারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা ( ইত্যাদি ছোট খাট অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভ করে এবং দরিদ্র মানুষ যাতে খাদ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গন্য হবে। আর যে ব্যক্তি তা ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গন্য হবে” । (সুনানে আবু দাউদ:২/১১১)

ঈদের দিনে করনীয়:

১. অন্য দিনের তুলায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকী:৬১২৬)
২. মিসওয়াক করা। হাদিসে রাসুল স: বলেন:

لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي أَوْ عَلَى النَّاسِ لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاةٍ

“যদি আমি আমার উম্মতের উপর কষ্টের আশঙ্কা না করতাম, তাহলে আমি তাদের প্রত্যেক সালাতের সময় মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম”।( বুখারী ও মুসলিম)

৩. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করা, ইবনে মাজাহ: ১ /৩১৫
৪.  শরীত সম্মত সাজসজ্জা করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৫. ঈদুল ফিতরের সালাতে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া। যেমন খেজুর ইত্যাদি খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম। আনাস রা: থেকে বর্ণিত:

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ
“ রাসূলুল্লাহ স: ঈদুল ফিতর দিন খেজুর খাওয়া পর্যন্ত অন্য কোন খাবার খেতেন না”।( বুখারী:৯৫৩)

৬. সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (আবু দাউদ: ১১৫৭)
৭. ঈদের সালাতের পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন:

من أداها قبل الصلاة فهي زكاة مقبولة , ومن أداها بعد الصلاة فهي صدقة من الصدقات

“যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গন্য হবে। আর যে ব্যক্তি তা ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গন্য হবে” । (সুনানে আবু দাউদ:২/১১১)

৮. ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। (বুখারী:৯৫৬)

যদি একান্ত মসজিদে আদায় করতে হয় তবে অবশ্যই মসজিদের প্রবেশের পর দু’ রাকাত নামাজ আদায় করা।

রাসূলুল্লাহ স: ইরশাদ করেন:

إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمْ الْمَسْجِدَ فَلَا يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ

“যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন দু’রাকাত সালাত আদায় করা পর্যন্ত না বসে” (সহীহ বুখারী: ৭৬১১)
৯. ঈদের সালাতে এক রাস্তা দিয়ে সম্ভব হলে অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন:

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيدٍ خَالَفَ الطَّرِيقَ

“রাসূলুল্লাহ স: ঈদের দিনে (ঈদগাহ থেকে ফিরার সময়) বিপরীত রাস্তা দিয়ে হাটতেন”। (বুখারী: ৯৮৬)
১০.. ঈদুল ফিতরের দিন আস্তে আস্তে এই তাকবীর পড়তে থাকাঃ
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে। (মুসতাদরিক হাকেম:৫০১১)

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلِتُكَبِّرُواْ اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

“তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর”। (সূরা বাকারা: ১৮৫)

ঈদ পরবর্তী করনীয়:

তাকওয়ার অনুশীলন:

রমজান মাস ছিল তাকওয়া অর্জনের মাস। আমরা রমজানে যেভাবে তাকওয়ার অনুশীলন করি রমজান শেষ হলে আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ কথা ছিল রমজানে তাকওয়ার যে প্রশিক্ষণ আমরা পেয়েছি তা সারা বছর কাজে লাগিয়ে জীবন পরিচালনা করব। এক জন রোজাদারের এই কথা মনে রাখা উচিত যে, যেই আল্লাহর সন্তষ্টি ও তাঁর ভয়ে সারাদিন ক্ষুদার যাতনা সহ্য করেছে সেই আল্লাহকে যদি রমজানের বাহিরে বাস্তব জীবনে ভয় করতে না পারি তাহলে তার রোজা শুধুমাত্র উপবাস ছাড়া আর কিছূই নয়। আমরা সামান্য বিপদে পড়লে বা কোন প্রকার হতাশ হলেই তাকওয়ার বিপরীত কাজ করে থাকি। অথচ তাকওয়া হলো সকল বিপদে আপদে আল্লাহর উপর ভরসা করে অন্যায় পথ থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ

“যে আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন এবং তিনি এমন উৎস থেকে রিযিক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনা”। (সূরা ত্বালাক:২-৩)

সুতরাং সর্বাবস্থায় তাকওয়ার পথ অনুসরণ করা একজন রোজাদারের বড় প্রশিক্ষণ।

কুরআনের ময়দানে আত্মনিয়োগ:

রমজান হলো পবিত্র কুরআনের মাস। রমজানের এত কদর ও সম্মান মূলত কুরআনকে ঘিরেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা বলেন:

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ

“রমজান মাস! যাতে সমগ্র মানব জাতীর হেদায়েতের জন্য কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা স্পষ্ট হেদায়েতের বাণী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী”। (সূরা বাকারা: ১৮৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۚ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

“আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে”। (সূরা হাশর: ২১)

আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে আরো বলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ * وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ * لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ* تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ * سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

“নিশ্চয়ই আমি একে ( কুরআনকে) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। ( হে রাসূল) আপনি কি জানেন, কদরের রাত্রি কি? – কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো।- ফেরেশতারা ও রূহ (জীব্রাঈল আ) এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত” ( সূরা কদর: ১-৫)।

সম্মানিত রোজাদার ভায়েরা! আল্লাহ তায়ালা এই কুরআন যে মাসে নাযিল করেছেন, সেই মাস আমাদের নিকট সম্মানিত, যে দিন নাযিল করেছেন সে দিন হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সুতরাং যদি আমরা এই কুরআনের আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারি তবে আমাদের জীবনও হবে সম্মানজনক ও বরকতময়। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: রাসূল স: বলেন:

تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما : كتاب الله ، وسنة نبيه – صلى الله عليه وسلم

“আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আকড়ে ধরলে তোমরা কখনোই লঞ্চিত হবেনা। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূলুল্লাহ স: এর সুন্নাহ তথা হাদিস”। (মুওয়াত্তা মালেক: ১৬৬১)

উল্লেখিত হাদিসের প্রতি লক্ষ করলে অনুমান করা যায় আমাদের সমাজের আজ মানুষ নির্যাতিত নিষ্পেষিত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমরা কুরআন থেকে দুরে সরে গেছি, কুরআনের হুকুম প্রতিনিয়ত অমান্য করছি। নিজের সুবিধা মত কুরআনের ‍কিছু আয়াত মানছি আবার নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া কুরআনের আয়াতগুলো অমান্য করছি। তাই সমাজে শান্তি ফিরেয়ে আনতে আমাদের আবার কুরআনের দিকেই ফিরে যেতে হবে। কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্ছ চেষ্টা সাধনা চালাতে হবে।

যৌতুক নামক সামাজিকতা দূর করুন:

সম্মানিত রোজাদার ভাই-বোন আমরা দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা ও আত্মসংযমের পর যখন ঈদের আনন্দে মেতে থাকি তখন আমরা কখনো কখনো নিজের মনের অজান্তে অথবা ইচ্ছা করেই সামাজিকতার আড়ালে যৌতুক নামক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যাই। মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ীতে কি পরিমান সেমাই-চিনি, পোশাক-আশাক পাঠালো তা নিয়ে চলে যল্পনা কল্পনা। নিজেদের ভিতরে চলে গীবতে চর্চা। “বৌ” নামক অসহায় মেয়ের উপর চলে কথার ধারলো ছুরি। অনেক সময় এ বিষয়টি শারিরীক নির্যাতনের পর্যায়েও পৌঁছায়। যা আমাদের পরিবারকে বিষিয়ে তুলেছে। সুতরাং আসুন সামাজিকতার নামে এই ধরণের যৌতুক বন্ধ করে সবার মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিই।

ঈদ ও পর্দাহীনতা:

ঈদের উৎসবকে কেন্দ্র করে যে গুনাহটি আমাদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা হলো পর্দাহীনতা। ঈদে নতুন ‘বৌ’ অথবা অবিবাহিত বোনকে আপনার বন্ধু বান্ধবদের সামনে ‍উপস্থাপনের একটি কুৎসিত রেওয়াজ রয়েছে যার মাধ্যমে মূলত আপনি আপনার স্ত্রী বা বোনকে যিনির দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। সম্মানিত ভাই, আপনি কি জানেন, আপনার আড়ালে আপনার বন্ধু-বান্ধব আপনার বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে কি মন্তব্য করে? অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا

“তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেয়ো না, নিসন্দেহে এটি হচ্ছে একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ”(সূরা ইসরা: ৩২)। তাছাড়া ঈদ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নানা রঙের অশ্লীল পোষাক যা রমজানের পরে রমজানের শিক্ষাকে একদম সিকে তুলে ফেলে। আমাদের পরিবার ও সমাজে আজ নারীরা যে পোষাক পরিধান করে তা উলঙ্গপনা ছাড়া আর কিছুই নয়।  অথচ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ

“তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করবে, পূর্বেকার জাহিলিয়াতের যামানার(নারীদের)মতে কখনো নিজেদের প্রদর্শনী করে বেড়াবেনা”(সূরা আহযাব: ৩৩)।

অন্য আয়াতে নারী ও পুরুষ উভকেই পর্দার ব্যাপারে বিধান নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ

“(হে রাসূল!) আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন তাদের চক্ষু (পরনারীদের থেকে) নিচু রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে”(সূরা নূর:৩১)।

অন্য আয়াতে নারীদের পর্দার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا

“(হে রাসূল!) আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে,তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে বেড়ায়”(সূরা নূর: ৩২)।

তাই আসুন রমজানের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের ভিতরে লুকিয়ে যেনার মানসিকতা পরিহার করি এবং পরিবার ও সমাজে পর্দার বিধান কায়েম করার চেষ্টা করি।

আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।

লেখক,
হাফেজ, মাও: নুরুল হুদা
কুরআনিক সায়েন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবির হাট, চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights