মানব সৃষ্টির রহস্য : একটি পর্যালোচনা
আল কুরআনের আলোকে মানব সৃষ্টির ইতিহাস
মানব সৃষ্টির রহস্য ও মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে এই পর্যালোচনা। সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ সৃষ্টি করার উপাদান ও স্তর আলোচিত।
মানব সৃষ্টি :
সৃষ্টির সেরা জীব “আশরাফুল মাখলুকাত” মানুষ। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এতটাই মর্যাদা দিয়েছেন যে, প্রথম মানব
আদমকে (আ.) সৃষ্টির পর ফেরেস্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন তাকে সেজদা করে। মানুষ এবং জ্বীন জাতি সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
মানুষ এবং জ্বীনকে শুধু আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি, (সূরা যারিয়াত ৫৬) । মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آَدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
‘আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং জলে-স্থলে তাদের আরোহণ করিয়েছি, তাদেরকে পবিত্র বস্তু দিয়ে রিজিক দিয়েছি এবং আমার বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি, (সুরা বনি ইসরাইল, ৭০) ।
আল্লাহর দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। তার কাছে তারাই বেশি সম্মানিত যারা পরহেজগার এবং আল্লাহভীরু। এক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্য, ক্ষমতা বা অন্য কিছু বিবেচনায় আসবে না। মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত’ (সূরা হুজুরাত, ১৩) ।
পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির রহস্য :
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন- وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“(স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, যে আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব” (সূরা বাকারা, ৩০)। খলিফা শব্দের অর্থ রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। যারা একে অপরের পরে আসবে এবং এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছাবে। আভিধানিক অর্থে কারো কাজ করার জন্য নিযুক্ত ব্যক্তি। আল্লাহ প্রদত্ত আমানত বহনের দায়িত্ব নিয়েছে বলেই মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি।
আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তার প্রথমেই দরকার আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা, শক্তি ও তাওফিক আর সেটাকেই বলে ‘রূহ’। আল্লাহ বলেন, وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
“তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, “(হে নবী) আপনি বলে দিন যে, (রূহ হলো) আমার প্রতি পালকের পক্ষ থেকে (একটি) নির্দেশ বা শক্তি, (সূরা ইসরা, ৮৫) ।
এইভাবেই শুরু হয়ে গেল আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি আদম তৈরির ধারাবাহিকতা। আল্লাহ আদমকে (আ.) ‘কূন’ শব্দ দিয়ে নয় বরং নিজ হাতে তৈরি করলেন এবং নিজ আত্মা থেকে ‘রূহ’ আদমের (আ.) মধ্যে ফুঁকে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ
পরে তিনি তাকে (আদম (আ.) সুঠাম করেছেন এবং তাঁর নিকট হতে তাতে রূহ সঞ্চার করেছেন। (সূরা সাজদাহ্, ৯)
মহান আল্লাহ ফেরেশতাগণের সঙ্গে পরামর্শের সুরে বললেন- আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ সৃষ্টি করতে চাই। ফেরেশতাগণ একবাক্যে নেতিবাচক মন্তব্য করল- তাঁরা বলল, আপনি কি এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যারা সর্বত্রই বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং রক্তারক্তিতে অবতীর্ণ হবে? বরং আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণগান করছি আর আপনার পবিত্রতা বর্ণনায় নিয়োজিত আছি। তাহলে আর মানুষ সৃষ্টি করার কী দরকার? মহান আল্লাহ বলেন- আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। এই হলো মানুষের প্রতি মহান রবের দরদ ও দায়বদ্ধতা, সৃষ্টি রহস্যের সব বিষয়ে অবগত যেই মহান সত্তা, তিনিই মানব সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ নিলেন এবং তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য :
আল্লাহ তাআলা সুনিপুণ করে সুন্দর আকৃতিতে মনোরম কাঠামোতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রতিনিয়ত আল্লাহর সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করে চলেছে। এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন , فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ
‘হে চক্ষুষ্মানরা! তোমরা গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ করো’ (সুরা হাশর, ২)। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে মানুষ সৃষ্টির চেয়ে মহাকাশ সৃষ্টিকে অতীব বিস্ময়কর মনে করেছেন। দিন দিন নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কারে বিস্মিত হয়েছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা উপলব্ধি করে না’ (সুরা মুমিন, ৫৭) ।
মানব সৃষ্টির উপাদান :
মানব শিশু জন্মের পূর্ব থেকে মহান আল্লাহ বিভিন্ন ধাপ অবলম্বন করেছেন। নারীর ডিম্বাণুর বহিরাবরণে প্রচুর সিয়ালাইল-লুইস-এক্সসিকোয়েন্স নামের চিনির অণুর আঠালো শিকল শুক্রাণুকে যুক্ত করে পরস্পর মিলিত হয়। আর এই শুক্রাণু দেখতে ঠিক মাথা মোটা ঝুলে থাকা জোঁকের মতো। জোঁক যেমন মানুষের রক্ত চুষে খায়, শুক্রাণু ঠিক তেমনি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে মায়ের রক্তে থাকা প্রোটিন চুষে বেড়ে ওঠে। নিষিক্ত ডিম্বাণুটি সন্তান জন্মের রূপ নিলে সাধারণত নিম্নে ২১০ দিন ও উর্ধ্বে ২৮০ দিন জরায়ুতে অবস্থান করে। ওই সময়ের মধ্যে ডিম্বাশয়ে নতুন করে কোনো ডিম্বাণু প্রস্তুত হয় না।
হাদীস শরীফে এসেছে, عن عَبْد اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ الصَّادِقُ الْمَصْدُوقُ أَنَّ خَلْقَ أَحَدِكُمْ يُجْمَعُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا أَوْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَهُ ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَهُ ثُمَّ يُبْعَثُ إِلَيْهِ الْمَلَكُ فَيُؤْذَنُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ فَيَكْتُبُ رِزْقَهُ وَأَجَلَهُ وَعَمَلَهُ وَشَقِيٌّ أَمْ سَعِيدٌ ثُمَّ يَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ-
‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ—সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়’ (বুখারি, ২৯৬৮) । এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ – ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ – ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آَخَرَ فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ –
‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে করেছি’ (সুরা মুমিনুন, ১৪) ।
মানব সৃষ্টির স্তর কয়টি :
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ হয়েছে, ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ
‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন এবং তাতে রুহ সঞ্চার করেন’ (সুরা সাজদাহ, ৯) । এখানে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। স্তরগুলো হলো মাটির সারাংশ, বীর্য, জমাট রক্ত, গোশতপিণ্ড, অস্থি পিঞ্জর, অস্থিতে গোশত দ্বারা আবৃত্তকরণ ও সৃষ্টির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রুহ সংহারণ, (মা’আরেফুল কুরআন, ৯১৪)। মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَكَّلَ بِالرَّحِمِ مَلَكًا يَقُولُ يَا رَبِّ نُطْفَةٌ يَا رَبِّ عَلَقَةٌ يَا رَبِّ مُضْغَةٌ فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَقْضِيَ خَلْقَهُ قَالَ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى شَقِيٌّ أَمْ سَعِيدٌ فَمَا الرِّزْقُ وَالْأَجَلُ فَيُكْتَبُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ-
‘আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনো তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতাটি বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেককার, রিজক কী পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব এভাবে তার তাকদির মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হয়’ (বুখারি, ৩০৮৭)।
নারী ও পুরুষের বীর্যের সংমিশ্রণ ঘুরতে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চতুর্দিকে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। যাতে করে ভ্রূণটি ধ্বংস হতে না পারে। এরপর আস্তে আস্তে একবিন্দু রক্তকণায় পরিণত হয় এবং সেই রক্তকণা গোশতপিণ্ডে ও অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়, এভাবেই সৃষ্টি হয় মানবশিশু,(বিজ্ঞান না কুরআন, ১০৯)।
মাতৃগর্ভে স্তর
মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃজঠরের তিনটি পর্দা বা স্তরের কথা পবিত্র কোরআনেও বলা হয়েছে। যথা— পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রূণের আবরণ বা ভ্রূণের ঝিল্লি গর্ভফুল, (বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, ২৭৭)। এই তিন স্তর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ
‘তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে— পর্যায়ক্রমে, একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে’ (সুরা জুমার, ৬) । আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কোরআনে যে ‘ত্রিবিধ অন্ধকারের’ কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি অন্ধকার হলো, ১. রেহেম, ২. মাশীমা বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট।
‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র-কন্যা উভয় দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল’ (সুরা শুরা, ৪৯) । এভাবেই সন্তান সৃষ্টির গূঢ় রহস্য বেরিয়ে এসেছে।
মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য :
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বের সার কথা হলো যারা ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নয়ন বিকাশ, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান, প্রতিভার বিকাশ সাধন, সৃজনশীল চিন্তার পুনর্গঠনের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বীরত্বে নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করে ধর্ম-কর্মে সাধুতা দিয়ে মানব কীর্তিকে সমৃদ্ধ করা।
আল্লাহর প্রতিনিধি তার ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের যে পদে কিংবা যে পেশায় নিয়োজিত থাকুক না কেন-সর্বাবস্থায় আল্লাহ প্রদত্ত আইন, বিধি-বিধান তথা আদেশ-নিষেধ-উপদেশ কুরআন বর্ণিত দিক-নির্দেশনার প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকবে।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। তাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব যাতে উপলব্ধি করা যায়, সেজন্য মানুষকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়েছে। মানব সন্তানের বাহ্যিক অবকাঠামো ও রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ
‘আমি মানুষকে অতি সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছি’ (সুরা তিন ৪) । আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘ তিনিই তো ওই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মায়েদের গর্ভে নিজের ইচ্ছামতো আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (আল ইমরান ৬) । আল্লাহ তায়াল বলেন “অবশ্যই মানুষ এমন একটি সময় (পেরিয়ে) এসেছিল, যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না” (সূরা দাহর, ১) । কিছুই ছিলনা অথচ মহান আল্লাহ তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। এই আয়াতে মানুষের অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, এর পরেও কেউ অহঙ্কার করলে ইবলিসের দলভুক্ত গণ্য হবে। আল্লাহ বলেন, আমার নির্দেশ আসার পর কে উত্তম কে অধম সেই চিন্তা করার সাহস কে দিল তোমাকে।
মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য মর্যাদা ও
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্মানিত করেছেন এবং সীমাহীন নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آَدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি, (সূরা বনি ইসরাইল, ৭০)।
প্রথমত, যে আকার-আকৃতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ শারীরিক কাঠামো মহান আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন, তা অন্য কোনো সৃষ্টবস্তুকে দেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয়ত, যে জ্ঞান মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যার দ্বারা তারা নিজেদের জীবন গতিশীল করার জন্য নিত্যনতুন বস্তু আবিষ্কার করেছে, অন্য কোনো সৃষ্টবস্তুকে তা দেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, মানুষকে আসমানি ওহি দেওয়া হয়েছে। এই জ্ঞান দিয়ে তারা কল্যাণ-অকল্যাণ, উপকারী-অপকারী ও ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম।
চতুর্থত, মানুষকে একধরনের বিশেষ জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সে আল্লাহর অন্য সৃষ্টবস্তু থেকে উপকৃত হতে ও বশে রাখতে সক্ষম। আল্লাহর কিছু সৃষ্টবস্তু এমন আছে, যেগুলোর শক্তিমত্তার কথা ভেবেও মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ মহান আল্লাহ সেগুলোও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। যেমন—চাঁদ, সূর্য, বাতাস, পানি মানুষের বশে নেই, কিন্তু দিব্যি এগুলো মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত।
আল্লাহকে নিয়ে নয়, আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার অনুমতি রয়েছে। ইসলাম গবেষণাকে ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমাদের সবার উচিত আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করে মহত্ত্ব ঘোষণা করা। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য উদ্ধার করছেন। অথচ অনেক আগেই এই তথ্য মানব কল্যাণে মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। বলা যেতে পারে, কোরআনই সুশৃঙ্খল কল্যাণকর অকৃত্রিম বিস্ময়কর এলাহি বিজ্ঞান এবং রাসুল (সা.) সর্বকালের যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল
শিক্ষক ও কলামিস্ট।
প্রভাষক (আরবী বিভাগ),
চাটখিল কামিল (এম.এ) মাদরাসা, নোয়াখালী
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.