ইহসান ও করণীয়
মোস্তফা মঞ্জর
১.
ইহসান (সদ্ব্যবহার) পেতে কার না ভালো লাগে। আমরা সবাই তা আশা করেই থাকি। নিজে যেমনই হই না কেন, অন্যের কাছে ভালো ব্যবহারটাই চাই। আর আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট থেকে ইহসান তো সকলেরই কাম্য।
অথচ ইহসান কেবল একপক্ষীয় ব্যাপার নয়। এটা পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়। আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে ইহসান চান; প্রিয় ভাই, আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির প্রতি ইহসান করুন। নিশ্চয়ই আপনিও উত্তমটাই ফেরত পাবেন।
২.
ইহসান কী? সহজ কথায়, প্রাপ্য হকের চাইতে বেশি দেওয়া। উদাহরণ দিলে হয়ত পরিষ্কার হবে। ধরুন,
নীলক্ষেত থেকে ক্যাম্পাসে যাবেন। রিকশা ভাড়া ২০টাকা। এবার রিকশায় উঠার পূর্বেই ভাড়া ঠিক করে নিলেন ২০ টাকা। তারপর নেমে তাঁকে ২/৫ টাকা বেশি দিলেন। এটা হলো ইহসান। এক্ষেত্রে ভাড়া ঠিক না করে ২৫ টাকা দিলেও ইহসান না-ও হতে পারে। কেননা রিকশাওয়ালা হয়ত ২৫ এর নীচে আসত না।
আরো একটা দিকও ইহসান হতে পারে। যেমন, বাজারে লেবুর দাম ২০ টাকা হালি। বিক্রেতা চাইল ২৫ টাকা। আপনি নিশ্চিতরূপেই জানেন যে ২০ টাকা বললে দিয়ে দেবে। এমতাবস্থায় তাঁকে সাহায্যের নিয়তে ২৫ দিয়েই কিনলেন। এটাও ইহসান।
প্রাপক হাসি দিক আর না-ই দিক, দু‘আ করুক আর না-ই করুক; আপনি কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ইহসানের হকদার হয়ে গেলেন। নিশ্চিত জানুন, আল্লাহ্ তা‘আলা এর সর্বোত্তম প্রতিদানই দেবেন।
৩.
আরো একটা বৈশিষ্ট্য মনে রাখা দরকার, ইহসান কোন করুণা নয়। এটা দাতা গ্রহীতা উভয়ের জন্যই সম্মানজনক। এজন্য দান-সাদাকা ইহসান নয়। এগুলোর বিনিময় অন্যরূপ। কেননা এতে গ্রহীতার প্রতি করুণা প্রকাশ পায়, গ্রহীতা নিজেকে ছোট মনে করে।
তাছাড়া সুন্দর করে কথা বলা, হাসি মুখে তাকানো, দোষ–ত্রুটি ক্ষমা করা, উত্তম কিছু শিক্ষা দান করা, যে কোন সাহায্য সহযোগিতা – এ সবই ইহসান।
তবে মনে রাখা উচিত, এসব কাজই হতে হবে ইসলামের গণ্ডির ভেতর। হারাম কাজে জান দিয়ে সহযোগিতা করুন, কিংবা গায়রে মাহরামকে যতই হাসি দেন- ইহসান তো দূরের কথা গুনাহ হবে নিঃসন্দেহে। এমন ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলার রহমত বাদ দিন, আযাবের ভয় করুন।
৪.
বর্তমান বাস্তবতায় আর্থিক বিষয়টা একটু বেশিই খেয়াল রাখা উচিত। কেননা এক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই নিজেদের আচরণের কোন ব্যাখ্যা পাই না। রিকশাওয়ালা ৫ টাকা বেশি চাইলেই মাথা গরম, তরকারীওয়ালা ২ টাকা বেশি চাইলে সমস্যা, ফেরিওয়ালা ১০ টাকা বেশি দাবী করলে গালাগালির শুরু। অথচ সে-ই আমরাই, রেস্টুরেন্টে ৫০/১০০ টাকা বকশিশ দিই অবলীলায়, একই জিনিস বসুন্ধরা থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিয়েও কিনি, বন্ধুদের আড্ডায় ১০০/২০০ টাকা কোন ব্যাপারই না আমাদের জন্য।
প্রিয় ভাই, একটু চিন্তা করুন। টাকাই যদি আমাদের সমস্যা হত, তাহলে এসব কাজে আমাদের মাথা কেমন গরম হওয়া উচিত ছিল। অথচ রিকশাওয়ালা ৫ টাকা করে বেশি নিলেও সারা মাসে মাত্র ১৫০ টাকা আপনার বেশি যাবে। যেখানে এক আড্ডাতেই আপনি এর চাইতেও বেশি খরচ করেন।
আরো চিন্তার বিষয়, এই ৫ টাকা হয়ত সে রিকশাওয়ালার পরিবারের ন্যূনতম খাবারের ব্যবস্থা করত। আমরা তা নিয়েই মারামারি করি। বাহ! কি বীরপুরুষ আমরা।
৫.
এক সাহাবীর ঘটনা বলি।
একদা এক ইয়াহূদী তাঁর নিকট কিছু কিনতে আসল। দাম নির্ধারণ করার পর সাহাবীর কি যেন মনে হল। তিনি বললেন, ‘ভাই তুমি ঐ পাশের লোকের নিকট থেকে তা কিনে নাও’।
কি আর করা। ইয়াহূদী সে একই মূল্যে তা পাশের জনের নিকট থেকে কিনে নিল। বিস্ময়কর হলো, পাশের দোকানীও ছিল ইয়াহূদী। ক্রেতা ইয়াহূদী বিস্মিত হয়ে পুনরায় সাহাবীর (রা.) নিকট আসল। বলল, ‘একটি বিষয় বুঝলাম না, তুমি কেন আমাকে ওই লোকের নিকট থেকে কিনতে বললে, অথচ তুমি জান যে সে একজন ইয়াহূদী।‘
সাহাবী (রা.) বললেন, ‘দেখো! আজকের মত আমার উপার্জন কম হয়নি, চলার মত হয়ে গেছে। অথচ ঐ লোকটি একটিও বিক্রয় করতে পারেনি। তুমি না কিনলে হয়ত তার পরিবার উপবাসেই রাত কাটাতে হত।‘
সুবহানাল্লাহ!! এটাই হল ইসলাম। পরিণাম ? ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
আর আমরা আমাদের মুসলিম ভাইদের নিকট থেকে ৫/১০ টাকা কম দিয়ে মনে করি, ‘আজ বেশ জিতলাম।‘ অনেকে রাতের বেলা কম দামে কেনার জন্য বসে থাকি। অথচ আমাদের সামর্থ আছে দিনের বেলাতেই তা কেনার। কিন্তু যে বিক্রি করছে সে কিন্তু নিরুপায়। দিনের আর রাতের বাজারের পার্থক্য করেও আমরা ভাবি – ‘আজ খুব লাভ হলো।‘
হায় যদি জানতাম, কে জিতল? আর কে পরাজিত হল? আমি না হয় জিতলাম; কিন্তু পরাজিত হলো আল্লাহ্ তা’আলার দীন, আমার ইসলাম।
৬.
ফেবুতে পড়েছিলাম –
একজনের ভাষ্য –
“আমার বাবা দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে সাধারণ জিনিসপত্র বেশি মূল্যে কিনতেন। অথচ এগুলো উনার প্রয়োজনীয় ছিল না। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত মূল্যও দিতেন। এ ব্যাপারটা নিয়ে একবার আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আপনি এরূপ করেন? বাবা উত্তর দিলেন,
‘বাবা ! এটা হচ্ছে মর্যাদার চাদরে মোড়া দানশীলতা’। [“It is a charity wrapped with dignity, my child!”]
৭.
আমাদের জীবনে এরূপ অবস্থা হরহামেশাই হয়। আর সম্ভবত আমরা প্রতিটাতেই ফেল করি। আমি ইহসান না করাকে নাজায়েজ বলছি না। হয়ত জায়েজ, কিন্তু উত্তম নয় কোনমতেই; আর ইসলামের আদর্শও তা নয়। বলতে চাচ্ছি, আমরা সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে সর্বোত্তম বিনিময় হারিয়ে ফেলছি। আমাদের নানা সমস্যায় আল্লাহ্ তা’আলার রহমত আর ইহসান চাচ্ছি, অথচ ছোট-খাট কিছু কাজ করে নিজে এমনিতেই আল্লাহ তা’আলার ইহসানের হকদার হতে পারি তা ভুলেই যাচ্ছি।
কি হবে, এমন কাজে যদি বাহ্যিক ২০০/৫০০ টাকা মাসে চলেই যায় !! বিনিময়ে কি আসবে তা হয়ত আমরা জানি না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, তা হবে অসীম দয়ালু আল্লাহর অসীম প্রতিদান। এতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখক: মোস্তফা মঞ্জুর বিশিষ্ট
ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.