
আমল কী এবং এর প্রতিদান কতো?
নেক আমল কাকে বলে? আমল দু’ধরনের - নেক আমল ও বদ আমল। আমল কী এবং এর প্রতিদান কতো?
আমল কী এবং এর প্রতিদান কতো?
আমল দু’ধরনের – নেক আমল ও বদ আমল। ঈমান ও নেক আমলে যারা সমৃদ্ধ তারাই জান্নাতি। ঈমান ও নেক আমল পরস্পর পরিপূরক। ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে নেক আমলের মধ্য দিয়ে। বলা যায় বীজ ও বৃক্ষ। জমিনে বীজ বপন করা হলে সেখান থেকে চারা গজায় এবং এটাই স্বাভাবিক। যদি বীজ থেকে চারা না গজায় তাহলে বুঝতে হবে বীজটা নষ্ট বা কোনো পাথরখণ্ডের নিচে চাপা পড়েছে। যে লোক আল্লাহ, পরকাল, রসুল ও কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করে তার পক্ষে কখনোই কোনো মন্দ কাজ সম্ভব নয়। তার দ্বারা আল্লাহর হক (নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত) এবং বান্দার হক পুরোপুরি আদায় হওয়াই স্বাভাবিক।
নেক আমল কাকে বলে? আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সকল ধরনের কাজই নেক আমল। আমাদের মাঝে নেক আমলের একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা রয়েছে। নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত, তাসবিহ -তাহলিল বা মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে তোলা ইত্যাদি ধর্মীয় লেবেলযুক্ত কাজই কেবল নেক আমল। আমলে সালেহ বা নেক আমলের ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। সুরা আসরে (মক্কায় অবতীর্ণ এবং প্রাথমিককালে) ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহপাক চারটি গুণের কথা বলেছেন। সেখানে ঈমানের সাথে নেক আমলের কথা বলা হয়েছে। সেসময়ে আমাদের ধারণামত নেক আমল কিছুই ছিল না এবং আল্লাহ নেক আমলের কোনো ফিরিস্তিও দেননি। বরং মানুষের বিবেক যে কাজটিকে ভালো বলে (যদি আল্লাহর সুস্পষ্ট নিষেধ না থাকে) সেটিই নেক আমল। আল্লাহপাক মানুষের প্রকৃতিতে নেক ও বদ আমলের ধারণা দিয়ে রেখেছেন। মানুষের বিবেক যে কাজটিকে ভালো মনে করে ইসলাম সে কাজকে আমলে সালেহ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় লোকদের প্রকৃতিতে মদ, নগ্নতা, জেনা-ব্যাভিচারের প্রতি ঘৃণা নেই বরং রয়েছে আসক্তি। এসব আচার -আচরণ ও কর্ম যেহেতু আল্লাহপাক হারাম করেছেন তাই সর্বাবস্থায় ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো বদ আমল এবং পরিণতি জাহান্নাম।
আমলের প্রতিদান সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ বান্দা কোনো নেক আমল করলে কেবল সমপরিমাণ নয় বরং সর্বনিম্ন দশ গুণ বৃদ্ধি করে দেন। এর চেয়ে অতিরিক্ত যা দেয়া হয় তা আমলকারীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতার ওপর নির্ভর করে। যেমন, আপনি নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে হাজির হলেন তাতে ন্যূনতম সওয়াব দশগুণ পেলেন কিন্তু তাকবিরে উলাসহ নামাজ আদায় করলেন তাতে আপনার সওয়াব বেড়ে যাবে, আবার প্রথম কাতারে হাজির হলেন এবং নামাজে একাগ্র হলেন ও পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন, এভাবে ক্রমান্বয়ে সওয়াব বাড়তেই থাকবে। আবার মনে করুন, আপনার বাসার কাজের মহিলাকে মাস শেষে বা পরের মাসের প্রথম দিন পারিশ্রমিক দিলেন (এটি তার হক)। সময়মতো দিলে দশ গুণ, কিন্তু মহিলার বিশেষ প্রয়োজনে যদি অগ্রিম দেন তাহলে সওয়াব বেড়ে যাবে। আবার পারিশ্রমিক দেয়ার সময় হাসিমুখে চকচকে টাকাটা দেন তাহলে সওয়াব আরো বাড়বে। কতো পর্যন্ত বাড়বে সেটি নির্ভর করছে আপনার আচরণ ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির ওপর। মনে রাখবেন, আল্লাহর মাঝে কোনো কার্পণ্য নেই; দেয়ার মাঝেই তাঁর যতো আনন্দ।
রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে আমি তো শুধু সওয়াবই দেখি। রাস্তায় মানুষকে সালাম দেয়ায় সওয়াব, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কোনো কিছু সরিয়ে ফেলায় সওয়াব, কোনো বোঝা বহনকারীকে সহযোগিতা করায় সওয়াব, বাসে চলতে পাশের ফাঁকা সিটে আন্তরিকতা দিয়ে একজনকে কাছে ডাকায় সওয়াব, বাসের ভাড়াটি না চাইতে দেয়ায় সওয়াব এবং আপনার বিবেক যে কাজে (যদি আল্লাহর নিষেধ না থাকে) সায় দেয় এমন সকল কাজে সওয়াব রয়েছে; কাজে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মানদণ্ডে সওয়াবের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মনে রাখবেন, আপনাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য (এটি আল্লাহর বাণী)। মানুষের কল্যাণে যে যতো অগ্রসর তাকে ততো অধিক সওয়াব দানের সাথে সাথে আল্লাহপাক তাকে সামাজিক নেতৃত্ব দান করেন এবং মানবকল্যাণে অগ্রসর জাতিকে আল্লাহ বিশ্বনেতৃত্বও দান করেন। এটিই আল্লাহর সুন্নাহ (নিয়ম)।
পারিবারিক জীবনটাও প্রশান্তি ও সওয়াবে পূর্ণ হতে পারে যদি পরিবারের সদস্যরা পরস্পর কল্যাণ সাধন করে। পরিবারে প্রশান্তির লক্ষ্যে যা করা হয় সবকিছুতে রয়েছে সওয়াব। সংসারে যা খরচ করা সেটি সদকা। শুধু সদকা নয় সর্বোত্তম সদকা। হাদিসের ভাষাটি লক্ষ করুন, একটি টাকা দাসমুক্ত কাজে ব্যয়, একটি টাকা আল্লাহর পথে জিহাদে ব্যয় এবং একটি টাকা আপন পরিবারের জন্য ব্যয়- এর মধ্যে সর্বোত্তম ব্যয় হলো আপন পরিবারের জন্য ব্যয়। আপনার জানা আছে কি স্ত্রী হিসেবে সংসারে কিছু খরচ করলে সেটা হয় সদকা এবং স্বামী দরিদ্র হলে তাকে জাকাত দেয়া যায়? স্বামী/স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের প্রতি নম্র আচরণে রয়েছে প্রভূত সওয়াব। স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানের মুখে আদর করে কিছু তুলে দেয়ায় রয়েছে অপরিমেয় সওয়াব। পরিবারকে আমরা বিনোদনকেন্দ্র ও শান্তিময় করে তুলতে পারি। স্বামী চাকরি বা কোনো কাজে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় স্ত্রীর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া এবং ধারেকাছে কেউ না থাকলে একটু আদর করে দেয়ায় দোষের কিছু নেই বরং রয়েছে সওয়াব। রসুল সা তাঁর উম্মতদের এমনটিই শিক্ষা
দিয়েছেন। সাহাবিরা রা. প্রশ্ন করেছেন, ইয়া রসুলুল্লাহ সা! আমরা স্বামী-স্ত্রী জৈবিক তাড়নায় যা করি তাতেও কি সওয়াব? জবাবে বলেছেন, হ্যাঁ। তোমরা ভিন্ন নারী-পুরুষ যদি তা করতে তাতে কি গুনাহ হতো? সাহেবায়ে কেরাম বলেছেন, হ্যাঁ অবশ্যই। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, এজন্যই তো তোমরা সওয়াব পাবে। আমরা পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল ও দয়ার্দ্র হই। কুরআন-হাদিস পড়ে মনে হয়, বিনয়ী ও নম্র আচরণকারীকে আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না।
বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যে কোনো নেক কাজে নিয়ত করলেই সওয়াব এবং কাজ সম্পাদন করলে তার সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে বদ কাজের নিয়তে কোনো গুনাহ নেই এবং বদ কাজ সম্পাদন করলে সমপরিমাণ গুনাহ; আবার তওবা করলে গুনাহ মুছে দেয়া হয়। আবার সেই গুনাহের কারণে বারবার অনুতপ্ত হওয়া ও আল্লাহর কাছে তওবা করা হলে আল্লাহ সেই পাপ কাজকে নেকিতে পরিবর্তন করে দেন।
দুর্ভাগ্য, আমাদের নেক আমলের ধারণা বড়ো অস্বচ্ছ। তাই আমাদের আচার-আচরণ, লেনদেন এতো কদর্যপূর্ণ। বিশ্বের বুকে আমাদের চেয়ে বড়ো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আর নেই। অথচ আমাদের দাবি, এই পৃথিবীতে আমরাই সবচেয়ে পরহেজগার (আল্লাহভীরু) এবং আমাদের রাজধানী মসজিদের নগরী। অস্বীকার করি না, নেক আমলের এটি একটি দিক কিন্তু ইসলামে নেক আমলের আর একটি দিক হলো আমাদের ব্যবহারিক জীবন হবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। কথাবার্তায় মিথ্যার লেশ থাকবে না, ওয়াদা- প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না, আমানতে খেয়ানত হবে না, সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি বলে কিছু থাকবে না, গুম- খুন-চুরি-ডাকাতি থাকবে না, জেনা-ব্যাভিচার ও নারী নির্যাতন থাকবে না, ধোকা-প্রতারণা- ভেজাল থাকবে না, ওজনে কারচুপি হবে না, সমাজে জুলুম-নির্যাতন থাকবে না; নির্বাচন হবে শতভাগ স্বচ্ছ এবং দেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে। শাসকরা তাদের নাগরিকদের প্রতি হবে দয়ার্দ্র এবং নাগরিকরা শাসকদের জন্য হবে দোয়াকারী। এমনটি হতে পারলেই আমরা হবো নেক আমলে সমৃদ্ধ এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুত জান্নাত আমাদের দান করবেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পছন্দমত নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.