সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

রমজান মাস রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের

রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে

আল্লাহপাক এই কুরআনকে নাজিল করেন রমজান মাসের এক মহিমান্বিত রজনিতে। কুরআনের কারণে রাত্রিটি হয়েছে হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম এবং রমজান মাস হয়েছে অসংখ্য রহমত, মাগফেরাত ও বরকতে ভরপুর।

মহিমান্বিত মাস রমজান

আল্লাহর ভাষায় কুরআন নাজিল হয়েছে شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلٰى مَا هَدٰىكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ – রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর (সূরা আল-বাকারাহ:১৮৫)।

এই কুরআনে কোনো অস্পষ্টতা নেই- হক ও বাতিল স্পষ্ট করা হয়েছে এবং এর বাইরে মানুষের জীবন পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। উক্ত আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যেহেতু রমজান মাসে মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআন নাজিল করা হয়েছে সেহেতু যারাই এই মাসটি পাবে তাদের জন্য পূর্ণ মাস রোজা রাখা অপরিহার্য। কুরআন মানার জন্য যে জিনিস অপরিহার্য সেটি হলো তাকওয়া। রোজা মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করে। আল্লাহর বাণী, يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ – হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।(সূরা আল-বাকারাহ:১৮৩) ।

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য

মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি এবং তাঁরই প্রতিনিধি। রমজান মাস রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের। আল্লাহপাক তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার এক পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর বড়ো আদরের সৃষ্টি মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কোনো ভুলের কারণে শাস্তিস্বরূপ নয় বরং এক মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই মানুষের এই পৃথিবীতে আগমন। মানুষের আদিবাস জান্নাত এবং এই পৃথিবীতে তার আগমন খুবই স্বল্প সময়ের। আল্লাহ তায়ালা আদম আ. -কে প্রথম সৃষ্টি করার পর তাঁর  হিসেবে সৃষ্টি করেন মা হাওয়া আ.-কে এবং আমরা সবাই তাঁদেরই সন্তান। সৃষ্টি করার পর তাঁদের স্থান দেওয়া হয় জান্নাতে। ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালার বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারী এবং তাঁরা খুবই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। আজাজিল জিন জাতির অংশ এবং কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ – আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে। (সূরা আয-জারিয়াত:৫৬) ।

আদমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহপাক ফেরেশতাদের সেজদা করার নির্দেশ প্রদান করেন। ইবলিস ব্যতীত সবাই সেজদা করেন। ইবলিস ছিল জিন জাতির অংশ এবং আগুনের তৈরি। পক্ষান্তরে আদম আ. মাটির তৈরি এবং ফেরেশতারা নুরের তৈরি। জান্নাতে আদম আ.-এর একটি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। জান্নাতে স্থান দিয়ে আল্লাহপাক আদম ও হাওয়াকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিয়ে একটি গাছকে নির্দেশ করে বলেন, ঐ গাছটির নিকটেও যেও না এবং সেখানে গেলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শয়তান তাঁদের কল্যাণকামী সেজে উভয়কে প্ররোচিত করে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা ভুলিয়ে দেয়। মা হাওয়ার প্ররোচনায় আদম আ. ফল ভক্ষণ করেছেন- এ কথার কোনো ভিত্তি নেই বরং কুরআনে আদম আ.-কে সম্বোধন করে কথাগুলো বলা হয়েছে।

মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ

আদম আ. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন- এমনটিও বলা যায় না, বরং ভুল উভয়ই করেছেন (আদম ও ইবলিস) কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো আদম আ. ভুল করার সাথে সাথে অনুতপ্ত হন ও ফিরে আসেন (তওবা করেন)। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মানবপ্রকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইবলিস ভুলকে স্বীকার না করে গর্ব ও অহঙ্কারে মেতে উঠে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। এই সমাজে মানুষ ভুল করে ভুলের উপর অনঢ় হয়ে না থেকে ফিরে আসলে সে তার পিতা আদমেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়, পক্ষান্তরে ভুলের স্বীকৃতি না দিয়ে নিজেকে বড়ো মনে করা শয়তানেরই অনুসরণ এবং ইবলিসের সাথে তার অনুসারীদের দ্বারা আল্লাহপাক জাহান্নাম পূর্ণ করবেন।

পরীক্ষা গ্রহণের পর আল্লাহপাক আদম আ.-কে পৃথিবীতে চলে আসতে বলেন এবং জানিয়ে দেন, তাঁর পক্ষ থেকে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই। আদম আ. প্রথম মানুষ ও প্রথম নবি এবং তাঁদেরকে নিষ্পাপ অবস্থায় শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ অবস্থায় দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়। জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রসুলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াত দান করেছেন এবং সর্বশেষ নবি ও রসুল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. ও সর্বশেষ হেদায়াত হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআন

রমজান মুত্তাকিদের জন্য

আল্লাহপাক কুরআন মজিদের শুরুতে বলেছেন, এই কুরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়ে নাফরমানি মূলক সকল কাজ থেকে দূরে থাকা। কাঁটাযুক্ত পথে চলতে গেলে মানুষ তার কাপড় গুটিয়ে যেভাবে অতি সন্তর্পণে চলে তারই নাম তাকওয়া (ওমর রা.-এর প্রশ্নেরজবাবে সাহাবি উবাই ইবনে কাব রা. বলেছিলেন)। এই সমাজে জেনা-ব্যাভিচার, নগ্নতা- বেহায়াপনা-অশ্লীলতাসহ হাজারো পাপাচারের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার নামই তাকওয়া এবং যে চলতে পারে তাকেই বলে মুত্তাকি। নির্দিষ্ট পোশাক বা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা মুত্তাকির পরিচায়ক নয়।

মুত্তাকি সম্পর্কে আল্লাহর নিজেরই দেওয়া একটি পরিচয় রয়েছে-لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ ءَامَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْءَاخِرِ وَالْمَلٰٓئِكَةِ وَالْكِتٰبِ وَالنَّبِيِّۦنَ وَءَاتَى الْمَالَ عَلٰى حُبِّهِۦ ذَوِى الْقُرْبٰى وَالْيَتٰمٰى وَالْمَسٰكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّآئِلِينَ وَفِى الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلٰوةَ وَءَاتَى الزَّكٰوةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عٰهَدُوا ۖ وَالصّٰبِرِينَ فِى الْبَأْسَآءِ وَالضَّرَّآءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولٰٓئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ – ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী। (সূরা আল-বাকারাহ:১৭৭ )

রমজান ফরজ হওয়া 

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত সকল নবি ও রসুলের উপর রোজা ফরজ ছিল। হয়তো সংখ্যা ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল। আমাদের জন্য পূর্ণ রমজান মাস রোজা রাখা ফরজ। সফরে থাকলে বা রোগগ্রস্ত হলে অন্য সময়ে সেই সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আবার চিররুগ্ন বা অতি বার্ধক্য হলে যার জন্য রোজা রাখা আদৌ সম্ভব নয়, সে ফিদিয়া দিয়ে রেহাই পেতে পারে। তাকওয়া অর্জনের ক্ষেত্রে রোজা অনন্য, এর কোনো বিকল্প নেই। সকল ইবাদতের মধ্যে কিছু লৌকিকতা বা প্রদর্শনী রয়েছে। যেমন নামাজ সকলের সাথে জামাতে আদায় করতে হয়, হজ দীর্ঘপথ অতিক্রম করে লোকজনের সাথে আদায় করা হয়, জাকাত অন্তত গ্রহীতা জানে কিন্তু রোজার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

রোজা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য আমিই তার পুরস্কার। সকলের সম্মুখে সেহরি খেয়ে সে লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো কিছুই গ্রহণ করে না এবং এই না করার পেছনে কারণ একটিই, তা হলো আল্লাহর ভয়। রোজাদার জানে, দুনিয়ার কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখছেন এবং কেবল আল্লাহরই ভয়ে সে পানাহার ও যৌন কামনা বাসনা পরিতৃপ্ত করা থেকে বিরত থাকে। সাউম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। পানাহার, যৌন চাহিদা ও সকল পাপাচার থেকে বিরত থাকার নামই সাউম বা রোজা।

তাকওয়া অর্জনে রমজান

অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি সামান্য সময়ের জন্য। কিন্তু রোজা দীর্ঘমেয়াদী এক প্রশিক্ষণ কোর্স। আল্লাহর হারামের তো প্রশ্নই উঠে না, হালাল খাদ্যখানা ও স্বামী- স্ত্রী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম করায় বান্দা কেবল তার রবের ভয়ে বিরত থাকে এবং এই বিরত থাকা একদিন দুদিন নয় টানা একটি মাস আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখার এক দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণে যে উতরে যাবে সে বড়ো সৌভাগ্যের অধিকারী এবং তার জন্য রয়েছে জান্নাতে প্রবেশের স্পেশাল দরজা। রোজাদারদের জন্য কত সুসংবাদ। হাশরের ময়দানে কোথাও ছায়া নেই, সে সময়ে দেখা যাবে একদল মানুষকে আরশের ছায়ায় খানাপিনায় ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করা হবে- এরা কারা? বলা হবে, এরা রোজাদার। রোজাদার সম্পর্কে কত খোশখবরি। রোজা রাখার ফলে মুখে যে দুর্গন্ধ দেখা দেয় তা আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত।

প্রতিটি আমলের সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় কিন্তু রোজা ব্যতিক্রম, রোজা সম্পর্কে বলা হয়েছে রোজা আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহই তার পুরস্কার অর্থাৎ জান্নাতই তার পুরস্কার। এখন প্রশ্ন, রোজা যদি উদ্দেশ্য বিবর্জিত হয় অর্থাৎ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে না হয়ে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়। আল্লাহর ভয়ে রোজা রাখা হলে অবশ্যম্ভাবী সে পাপাচার মুক্ত হয়ে পড়বে। অর্থাৎ সুদ-ঘুষ, নগ্নতা- অশ্লীলতা-পর্দাহীনতা, ওজনে কম ও ভেজাল দেয়া, ধোকা-প্রতরাণা, মিথ্যা-শঠতা সবধরনের গুনাহের কাজ থেকে সে বিরত হয়ে পড়বে। আর এমন যদি না হয় সেক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে রোজাদার মিথ্যা ও পাপ ছাড়তে পারলো না তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই। মোট কথা রোজা রাখার মধ্য দিয়ে মানুষকে পরিশুদ্ধ হতে হবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রোজা রাখা হলে পরিশুদ্ধ না হয়ে পারে না। রোজা রেখে গালিগালাজ ও মন্দবলা, ঝগড়া-ঝাটি, বিবাদ-বিসংবাদ করা যায় না, কেউ করতে চাইলে হাদিসের ভাষায় বলতে হবে ভাই, আমি রোজাদার।

বরকতের মাস রমজান

রমজান মাসের বরকত ও ফজিলত গণনা করে শেষ করা যায় না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, এই মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, তার নমুনা দেখা যায় মসজিদগুলোয় উপচেপড়া ভীড়। রসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, এই মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি আরো বলেছেন, রমজান মাসে একটি ফরজ ও অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান এবং একটি নফল অন্য সময়ের একটি ফরজের সমান। রমজান মাসে সেহরি ও ইফতার খাওয়ার মাঝেও সওয়াব। এ যেন সওয়াব কামানোর এক মওসুম। কুরআনের কারণে রমজান মাস এত দামি হয়ে পড়েছে। এ মাসে রোজা ফরজ করা হয়েছে এবং

রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যারা ইমান ও ইহতেছাবের সাথে রোজা রাখবে আল্লাহ তার পেছনের গুনাহ মাফ করে দিবেন। রমজানের প্রাক্কালে রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আল্লাহপাক রমজানের রোজা ফরজ করেছেন এবং আমি তোমাদের প্রতি রাতের নামাজ নফল করছি। যারা ইমান ও ইহতেছাবের সাথে রাতে দণ্ডায়মান হবে আল্লাহ তাদের অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। রমজানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদর এবং বলা হয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। রসুলুল্লাহ সা. শেষ দশকে বেজোড় রাতসমূহে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলেছেন এবং বলেছেন, যারা ইমান ও ইহতেছাবের সাথে রাতে দণ্ডায়মান হবে আল্লাহপাক তার পেছনের গুনাহ মাফ করে দেবেন। শবে কদর তালাশের জন্য রসুলুল্লাহ সা. শেষ দশকে নিয়মিত ইতেকাফ করতেন।

মানুষ ভুল করবে আর আল্লাহপাক ধরে ধরে সবাইকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন- এটি আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় নয়। আল্লাহ চান তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে। ক্ষমা করার নানা প্রক্রিয়া আল্লাহ বলে দিয়েছেন। বান্দা গুনাহ করার পর অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসলে অর্থাৎ তওবা করলে আল্লাহ তার কৃত অপরাধের জন্য আর শাস্তি দেবেন না। এ ছাড়া নামাজ আদায়, অজু ও নেক আমল বান্দার গুনাহ দূর করে দেয়। দুই নামাজের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ আল্লাহ নামাজের মাধ্যমে মাফ করে দেন। গুনাহ মাফের অপূর্ব সুযোগ রমজান মাস।

গুনাহ মাপের মাস রমজান

একদিন মিম্বরে আরোহন করার সময় রসুলুল্লাহ সা. আমিন আমিন বলেন। সাহাবিদের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, জিবরাইল আ. এইমাত্র বলে গেলেন যে রমজান মাস পেল অথচ গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম আমিন (দীর্ঘ হাদিসের অংশ)। পাহাড় পরিমাণ গুনাহ নিয়ে বান্দা যদি আল্লাহর কাছে ধর্ণা দেন তাহলে তিনি আকাশ ছোঁয়া ক্ষমা নিয়ে বান্দার সম্মুখে হাজির হবেন। আল্লাহর বাণী, قُلْ يٰعِبَادِىَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلٰىٓ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُۥ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ – বল, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আয-যুমার:৫৩)

ক্ষমা একটি প্রক্রিয়ার অংশ

প্রথমত গুনাহের পরে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে গুনাহ থেকে ফিরে আসলে (তওবা করলে) আল্লাহ ক্ষমা করবেন। এ ছাড়া বড়ো বড়ো গুনাহ থেকে বিরত থাকলে ছোট গুনাহসমূহ এমনিতেই ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহপাক ক্ষমাশীল ও করুণাময়- এই গুণের বরকতে তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন। বিশেষ বিশেষ দিন, ক্ষণ, মাসে তিনি তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। প্রতিদিন রাতের প্রথম প্রহর পরে তিনি নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, কেহ আছ ক্ষমা চাও, রিজিক চাও আমি তোমাদের দেব। এ সবই হাদিস থেকে জানা যায়। তওবা ছাড়া ক্ষমা করার ক্ষেত্রে বাদ পড়ে মুশরিক ও হিংসুক।

মুশরিক সেই যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে ইলাহ মেনে তার আনুগত্য করে। কুরআনের দাবি, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’- সুরা আন নাহল ৩৬। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন। ইসলাম ছাড়া যারা অন্য কিছু চায় তারাও আল্লাহর সাথে শিরক করে। বিশ্বাসের দিক দিয়ে একজন মুসলিমকে স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে, আল্লাহ তার একমাত্র ইলাহ (হুকুমকর্তা) এবং ইসলাম তার একমাত্র জীবনাদর্শ (দীন) অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু সে মানে না। আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু ইমানের ত্রুটি ক্ষমার যোগ্য নয়।

দ্বিতীয় হিংসা-বিদ্বেষ। আল্লাহ চান, তাঁর ইমানদার বান্দারা হিংসা ও বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপন করবে। উম্মাহর মাঝে দলাদলি ও অনৈক্যের মূলে রয়েছে হিংসা ও বিদ্বেষ। আল্লাহর ক্ষমা পেতে হলে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করতে হবে। আমরা এখন রমজান মাসের রহমতের মাঝে রয়েছি। গুনাহ মাফের এক অফুরন্ত সুযোগ। আল্লাহপাক আমাদের রমজানের পুরো বরকত লাভের লক্ষ্যে যথাযথ তাকওয়া অর্জন এবং সকল পাপাচার থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: মো.ইয়াছিন আরাফাত
ইসলামিক প্রবন্ধ

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights