সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

শিশুদের প্রতি ভালোবাসা প্রিয় নবীজীর

শিশুদের প্রতি ভালোবাসা

নবী করিম (সা.) শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও অনেক স্নেহ করতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা ইতিহাস চিরদিন মনে রাখবে। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا  অর্থ: “যে ব্যক্তি শিশুদেরকে স্নেহ করে না এবং বড়দেরকে সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়”। (তিরমিজি, ইফা : ১৯২৫)

রাসুল (সা.) শিশুদের মনের অভিব্যক্তি বুঝতে পারতেন। তাদের চাওয়া-পাওয়া মান-অভিমান সবই আপন করে নিতে পারতেন। ছোটদেরকে দেখলে আনন্দে নবীজির বুক ভরে যেত। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। শিশুরা কাছে এলে তাদেরকে কোলের উপর বসিয়ে খেজুর চিবিয়ে খাওয়াতেন, চুমু দিতেন। শিশুদের কষ্টের কথা ভেবে তিনি ফরজ নামাজের জামায়াত সংক্ষিপ্ত করার কথা বলেছেন। তাই শিশুরাও একাকার হয়ে যেত নবীজীর ভালোবাসায়। বিশ্বনবী হয়েও তিনি শত ব্যস্ততার মাঝে শিশুদের খোঁজখবর নিতেন। এভাবেই রাসূল (সা.) শিশুদের প্রতি তাদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতেন।

নীচে রাসুল (সা.)-এর শিশুদের প্রতি ভালোবাসার কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হলো।

শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিরন্তর :

আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সফর থেকে ফিরে আসলে তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য আমাদের (ছোটদের) নিয়ে যাওয়া হতো। আমাদের মধ্যে যে সবার আগে তাঁর নিকট পৌঁছতো, তিনি তাকে তাঁর বাহনের সম্মুখে বসাতেন। একদা আমাকে সবার আগে পেয়ে তিনি তাঁর বাহনে সামনের আসনে আমাকে বসালেন, অতঃপর হাসান বা হুসাইন (রাঃ)-কে পৌঁছানো হলো। তিনি তাকে পিছনের আসনে বসালেন। আর ‘আমরা (তিনজন) আরোহী অবস্থায় মদীনায় প্রবেশ করলাম। [সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৫৬৬]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, একবার এক ইয়াহূদীর ছেলে রোগাক্রান্ত হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে যান। তিনি তার শিয়রে বসে বলেনঃ তুমি ইসলাম কবূল কর। তখন ছেলেটি তার পিতার দিকে তাকায়, যে তার শিয়রে বসা ছিল। তখন তার পিতা তাকে বলেঃ তুমি আবুল কাসিমের আনুগত্য স্বীকার করে নাও। তখন ছেলেটি ইসলাম কবূল করে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ বলতে বলতে দাঁড়ানঃ সব প্রশংসা আল্লাহ্‌রই, যিনি আমার কারণে তাকে দোযখের আগুন হতে মুক্তি দিয়েছেন। [আবু দাউদ, ইফা : ৩০৮২] 

এতিম শিশুদের প্রতি ভালোবাসা :

রাসূল (সা.) বলেন, أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ، فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا ‏”‌‏.‏ وَقَالَ بِإِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى
অর্থাৎ, আমি ও ইয়াতীমের তত্বাবধানকারী জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকবো। এ কথা বলার সময় তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল মিলিয়ে ইশারা করে দেখান‏ [সহীহ বুখারী, ইফা : ৫৫৭৯]

একদিন একটি ছোট্ট শিশুকে দেখে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এই শিশুরাই তো জান্নাতের প্রজপতি তুল্য। [সহীহ মুসলিম, বা/হা ৬৫৯৫]তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদেরকে স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়ালু হও। এগুলো অবশ্য তিনি নিজেও বাস্তবে পালন করে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। নবীজী যখন কোথাও সফরে বের হতেন, রাস্তায় কোন শিশুকে দেখলেই তাকে তাঁর উটের পিঠে তুলে নিতেন এবং তার নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন।

নিজ শিশুসন্তানের প্রতি ভালোবাসা :

তিনি প্রানাধিক কন্যা “খাতুনে জান্নাত” হজরত ফাতিমা (রা:) কে স্নেহ করে বলতেন, ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা। শিশু ফাতিমা যখনি তাঁর কাছে যেতেন, তিনি উঠে দাড়াতেন এবং ফাতিমার হাত ধরে চুমু দিয়ে তাকে মজলিশে বসাতেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন, একবার রাসূল (সা.) নিজে হাসান (রা:) কে চুমু খেলেন। সে সময় তার কাছে আকরা বিন হারেস উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, আমি দশ সন্তানের জনক। কিন্তু আমি কখনো তাদের আদর করে চুমু খাইনি। নবী করীম (সা.) তখন বললেন, যে শিশুদের প্রতি দয়া করে না, তাকেও দয়া করা হয় না। [সহীহ বুখারী, ইফা : ৫৫৭১]। রাসুল (সা.) বলেছেন, শিশুদের ঘ্রাণটা জান্নাতি। তোমাদের সন্তানদের বেশি বেশি চুমু দেবে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তোমার জন্য জান্নাতে একটা উত্তম স্থান দান করবেন।

নিজ নাতীদের প্রতি ভালোবাসা :

মহানবী (সা.) তাঁর নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং অন্যদের সামনেই তাদেরকে চুমু খেতেন। মাঝে মাঝে ঘোড়া সাজতেন আর দুই নাতি পিঠে সওয়ার হতেন। অনেক সময় নবীজী (সা.) যখন নামাজে সিজদায় যেতেন, শিশু নাতিদ্বয় তাঁর পিঠে চড়ে বসতেন। নাতিরা তাঁর পিঠ থেকে না নামা অব্দি তিনি সিজদারত অবস্থায় থাকতেন। কখনোই বিরক্তবোধ করতেন না, নিষেধও করতেন না। হযরত উসমান ইবনে যায়েদ (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার তার উরুর উপর আমাকে আর অন্য উরুর ওপর হযরত হাসান (রা:) বসিয়ে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! এ দুজনের প্রতি রহম করো। কেননা আমি তাদের স্নেহ করি, ভালোবাসি।  (বুখারী)

নিজ শিশুসেবকদের প্রতি ভালোবাসা:

হজরত আনাস (রা:) মাত্র ৮ বছর বয়স থেকেই রাসুল (সা.)-এর ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি রাসুল (সা.)-এর মত শিশুদেরকে এত ভালোবাসতে দেখিনি। আমার কোন কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি, “এমন কেন করলে?” বা “এমনটি করোনি কেন?” (মুসলিম, ইফা : ৫৮০৫)

উম্মু কায়স বিনত মিহসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি তার এক ছোট ছেলেকে, যে তখনো খাবার খেতে শিখেনি, নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুটিকে তাঁর কোলে বসালেন। তখন সে তাঁর কাপড়ে পেশাব করে দিল। তিনি পানি আনিয়ে এর উপর ছিটিয়ে দিলেন এবং তা (ভাল করে) ধুইলেন না। [সহীহ বুখারী, ইফা : ২২৩] শুধু মুসলিম শিশুরাই নয়, ভিন্ন ধর্মের শিশুরাও ছিল নবী করীম (সা.)-এর স্নেহের পাত্র।

মদিনায় হিজরতের সময় শিশুদের প্রতি ভালোবাসা :

রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের সময় কচিকাঁচা শিশুদের আনন্দে হাসির কলরোল যেন গোটা মদিনা শহরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আরেকবার রাসুল পাক (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা কোন এক সফর শেষে মদীনায় ফিরছিলেন। আবু নাঈম বললেন, মহানবীর কাফেলা শহরের দিকে আসছে এটা দেখতে পেয়ে আমরা আমাদের খেলাধুলা বন্ধ করে দিলাম এবং প্রিয় নবীর আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার হল কোনকিছুই আমাদেরকে খেলাধুলা থেকে কখনো বিরত রাখতে পারত না।

কিন্তু সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকা প্রিয় নবীজিকে দেখলেই আমরা খেলা ভুলে যেতাম। রাসূল (সা.)-এর কাফেলা যখন শহরে ঢুকে পড়লো তখন আমরা শিশুরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত অবস্থায় তাঁর দিকে ছুটে গেলাম। ভ্রমণের কারণে শ্রান্ত ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের জন্য থামলেন এবং আমাদেরকে তাঁর দিকে আসার জন্য সাহাবীদেরকে পথ ছেড়ে দিতে বললেন। আবু নাঈম বললেন, আমার ছোট্ট বন্ধুদের অনেকেই রাসূল (সা.)-কে জড়িয়ে ধরলো এবং কেউ কেউ খুশিতে মত্ত হয়ে তাঁর চারিদিকে পাখির মত ঘুরতে থাকলো।

শিশুদের সাথে রাসুল (সা.)-এর রসিকতা :

প্রিয়নবী (সা.) শিশুদেরকে যেমন আদর করতেন তেমনি আবার তাদের সাথে রসিকতাও কম করতেন না। একবার হযরত আনাস (রা:)-র ছোট এক ভাইয়ের একটি পাখি মারা যায়। এতে তার মন খারাপ হয়। নবীজি তখন তাকে আদর করে কাছে ডেকে নিলেন। কবিতার ছন্দে তাকে জিজ্ঞেস করে বললেন,

“ইয়া আবা উমায়িরু মা-কা-আলান নুগায়রু? — অর্থাৎ হে আবু উমায়ের! তোমার পাখির ছানাটির কি হলো?” তখন ছেলেটি নবীজির মুখের ছন্দ ও সুর শুনে নিজেই হেসেই ফেললো। (বুখারী, ইফা: ৫৬৯৯)

অপর একটি ভিন্ন ঘটনা। একদিন এক মহিলা তার ছেলের হাতে কিছু আঙ্গুর ফল দিয়ে সেটা নবীজিকে দিয়ে আসতে বললেন। ছেলেটি আঙ্গুর ফলগুলো নবীজির কাছে না এনে নিজেই সব খেয়ে ফেললো। নবীজি বিষয়টা জানতে পারলেন। তিনি ঐ শিশুটিকে আদর করে কোলে তুলে নিলেন তারপর বললেন, ” কি হে! বলোতো দেখি মায়ের দেওয়া আঙ্গুরগুলো কোথায় হারিয়ে গেল?” শিশুটিও লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

শিশুদের মানসিক বিকাশ গঠনে রাসুল (সা.)-এর ভূমিকা :

শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য রাসূলে করীম (সা.) ছোটদের সঙ্গে নিজেও যেমন কোমল ব্যবহার করেছেন অপরদিকে অন্যদেরকেও তাদের প্রতি সর্বদা সদাচার করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি চাইতেন শিশুরা যেন কোন সময় কষ্ট না পায় বা নির্যাতনের শিকার না হয়। শিশুদের যেকোন মৌলিক চাহিদা মেটাতে তিনি সব সময় ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল।

এছাড়া সন্তান মেয়ে হোক বা ছেলে হোক ইসলামের দৃষ্টিতে ভিন্নচোখে দেখার কোন সুযোগ নেই। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যার কন্যা সন্তান আছে  অথচ সে তাকে হত্যা করেনি, অবহেলা করেনি, পূত্রসন্তানকে তার উপর  দেয়নি আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আবু দাউদ)। একবার জনৈক ব্যক্তি তার দুই সন্তানদের মধ্যে একজনকে চুমু খেলো অপরজনকে খেলো না। এই দৃশ্য দেখে নবীজী তাকে রাগত:স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তুমি তোমার সন্তানদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার করলে না?

শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ভূমিকা :

শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাসূলুল্লাহ (সা.) অধিক সর্তকতা অবলম্বন করেছেন। হযরত কায়েস ইবনে আসেম (রা:) ইসলাম গ্রহণের পর নবীজীর কাছে এসে বললেন, আমি (জাহিলি যুগে) কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিয়েছি। উল্লেখ্য, জাহেলী যুগে জীবিতাবস্থায় সন্তানদেরকে মাটিচাপা দিয়ে অনৈতিক আনন্দ-উল্লাস করা হতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবীর ঘটনা শুনে ভীষনরকম বেদনাক্রান্ত হয়ে গেলেন এবং উপায়স্বরূপ বললেন, প্রতিটি কন্যার বদলে একজন করে দাস মুক্ত করে দাও। সাহাবী বললেন, আমি তো কেবল উটের মালিক। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, তাহলে প্রতিটি কন্যার বদলে একটি করে উট কোরবানি করো। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৮৩৩৫)

এ ব্যাপারে তিনি শিশুহত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপন পন্থায় ধ্বংস করবে না।” (আবু দাউদ)। ইসলামী আইন ব্যবস্থায় মানব ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি ধারালো অস্ত্র দ্বারা শিরচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু শিশু হত্যার বেলায় এহেন জঘন্য অপরাধের বেলায় ইসলামে আরো কঠোরতার নমুনা পাওয়া যায়। একবার এক ‘রাহাজান’ একটি শিশুর অলংকার ছিনতাই করে তাকে পাথরে পিষে হত্যা করে। পরে ঐ শিশুহত্যার মৃত্যুদন্ড কোন ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়নি। তাকেও পাথরে পিষে হত্যা করা হয়। আজ সারাবিশ্বে শিশু অপহরণ, নির্যাতন চলছে অহরহ। এখনো  শিশুশ্রম চলছে দেদারছে। কেউ কেউ অপরাধীও হয়ে উঠছে। বাড়ছে কিশোর গ্যাং অপরাধ। পৃথিবীটা যেন আজ ক্রমেই শিশুদের জন্য অনিরাপদ আবাসস্থল হয়ে পড়ছে।

শিশুদের শিষ্টাচার শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-র বাণী

তিনি বলেছেন, সন্তানদেরকে সম্মান করো এবং তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দাও। (ইবনে মাজা)। একটি শিশু জন্মের সাথে সাথেই তার কানে আজান দিয়ে তাওহিদের মহান বাণী তার কানে পৌছে দিতে বলেছেন। তিনি কখনো কোনো শিশুকে বিকৃত নামে ডাকতেন না। তিনি তাদের অর্থবোধক নাম রাখতেন এবং মিষ্টি সুরে সুন্দর নাম ধরে ডাকতেন।

তিনি শিশুদের সাথে শিশুসুলভ ভংগিতে, নিচুস্বরে, নরম গলায় কথা বলতেন। রাসূল পাক (সা.) কখনো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না, চোখ রাঙাতেন না, কর্কশ ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতেন না। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন,  তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তাদের সাথে মজার মজার কথা বলতেন। তিনি শিশুসন্তানদেরকে সুশিক্ষা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।

শিশুদের উত্তম ও যুগোপযোগী শিক্ষাদানের জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেছেম, তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান করো। কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট। (মুসলিম)। শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি কখনো একবার কোন খারাপ ধারণা বা ভয়ভীতি প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেটা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সাথে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নিতে নিষেধ করেছেন। শিশুদের দুষ্টুমীতে তিনি কখনো বিরক্তবোধ বা কড়া শাসন করতেন না। বরং সুন্দরভাবে তাদের বোঝার মত করে বুঝিয়ে দিতেন। তিনি শিশুদেরকে কবিতা শিক্ষা দিতে বলেছেন যাতে তাদের উচ্চারণ শুদ্ধ হয় এবং বাচনভংগি মিস্ট হয়।

শিশুদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা :

জন্মের পর থেকে তাদের নিরাপদে বেড়ে ওঠা অব্দি প্রতিটি শিশুর কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে। শিশুদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এগুলোর যথাযথ সংরক্ষনের নিমিত্তে রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বদা সোচ্চার এবং সবসময় জোরদার ভূমিকা গ্রহন করেছেন। শিশুরা যেন কষ্ট না পায় বা নির্যাতনের শিকার না হয় সে ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে তিনি ছিলেন বিশেষ যত্নশীল।

তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে ১৫০০ বছর আগেই নিজ কর্ম, বিভিন্ন উপদেশাবলী ও আরো নানা উপায়ে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিশ্বকে এক শিশুবান্ধব সমাজ উপহার দিয়ে গিয়েছেন। এছাড়া জন্মের পর থেকে ২ বছর বয়স অব্দি মায়ের দুধ পান করার অধিকারের কথা ঘোষনা করেছেন আল-কুরআনের মাধ্যমে। জন্মের ৭ দিনের মাথায় নবজাতক শিশুটির ৩টি অধিকারের কথাও ঘোষনা করে গেছেন। তাহলো – (১) মাথা মুন্ডন করা (২) নতুন নাম রাখা ও (৩) আকিকা করা। এটা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার।

আরেকবার নোমান ইবনে বশীর নামের এক ব্যক্তি বলেন, তার পিতা একদিন তাকে একটা জিনিস উপহার দিলেন, অথচ তার অন্য ভাইকে দিলো না। এটা নিয়ে তার পিতামাতার মধ্যে বচসা হয় এবং নবীজীর কাছে বিচার দেওয়া হলো। নবী করিম (সা.) এটাকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারলেন না এবং এরূপ অসম ভালোবাসাকে  নিরুৎসাহিত করলেন। ভালোবাসা ও স্নেহ শুধু নিজের বাচ্চাদের প্রতি সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়।

বরং ইসলামের দৃষ্টিতে সব শিশুর প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা আবশ্যক। বিশেষকরে মা-বাবার মমতা দিয়ে শিশুদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখা উচিৎ। শিশু নির্যাতন রোধে রাসূলুল্লাহ (সা.) আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও শাস্তি কার্যকর করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন শিশু ক্রীতদাসকেও সন্তানের স্থানে উন্নীত করে গেছেন।

নবীজির প্রতি শিশুদেরও ভালোবাসা :

শিশুদের প্রতি এহেন মুহাব্বতের কারণে শিশুরাও মহানবী (সা.)-কে গভীরভাবে ভালোবাসতো। মহানবীর জন্য তাদের জীবনও বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করতো না তারা। বিশ্বনবীর প্রতি তাদের ভালোবাসার উজ্জ্বল এক উদাহরণ হলো দ্বিতীয় হিজরীতে অনুষ্ঠিত বদরের যুদ্ধে দুই কিশোর ভ্রাতৃদ্বয় মুয়াজ ও মুয়াব্বের কতৃক ইসলামের চরম দুশমন আবু জেহেলকে হত্যা করে রাসুল (সা.) প্রতি তাদের ভালোবাসার উজ্জ্বল নমুনা পেশ করেছিল।

তাদের প্রিয় রাসুল (সা.)-এর অপমানকে তারা কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনি। হজরত আবু জায়েদ (রা:),  হজরত আবু হুরায়রা (রা:)সহ বহু কিশোর নবীজীর ভালোবাসা পেয়ে কখনো তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেননি। নবীজী (সা.) কোন পথ দিয়ে আসবেন সেটা জানতে পারলে সে এলাকার শিশুরা পথের দু’পাশে এসে হাজির হতো। নবীজীর আগমন ঘটলে তারা নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস শুরু করে দিতো। নবীজীও স্বাভাবিকভাবেই তাদের আনন্দের সাথে শামীল হয়ে যেতেন। শিশুরাও নবীজীর আদরের ছোঁয়া পেয়ে আনন্দে উচ্ছল-উদ্দাম হয়ে উঠতো।

জাতিসংঘের ঘোষণা:

১৮৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষরদানকারী দেশগুলোর অন্যতম। সেই নিরিখে জাতিসংঘ শিশুদের অধিকার রক্ষায় অনেক পদক্ষেপ নিলেও তাদের মানবাধিকার রক্ষায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে সামর্থ্য হচ্ছে না। যেমন আফগানিস্থান, ইরাক, ফিলিস্থিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, চীনের উইঘুর মুসলিম শিশুসহ কত শিশু যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছে। জাতিসংঘ কিছুই করতে পারছে না।

অথচ রাসুল পাক (সা.) যুদ্ধে নারী ও শিশু হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। একবার এক যুদ্ধে কয়েকজন শিশু মারা যায়। তারা ছিলো শত্রুপক্ষের। এ খবর এসে পৌছুলে রাসুল (সা.) দারুণভাবে মর্মাহত হলেন এবং খুবই আফসোস করতে থাকলেন। তাঁর এ অবস্থা দেখে একজন সৈনিক বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি যাদের জন্য এতো মর্মবেদনা উপলদ্ধি করছেন তারাতো অমুসলিমদের সন্তান। রাসুল (সা.) তার কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, এখন থেকে সাবধান হও। কখনো শিশুদের হত্যা করবে না। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ ফুলের মতো।

অথচ একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য জাতিসংঘ “শিশু অধিকার সনদ”-এর ২৭ নম্বর ধারায় প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম এই সনদ বহু আগেই উল্লেখ করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) আজ থেকে ১৫০০ বছর আগেই নিজের কর্ম উপদেশসহ আরো নানা উপায়ে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিশ্বকে একটি ‘শিশুবান্ধব’ সমাজ উপহার দিয়ে গেছেন। তাই ইসলামের শিক্ষা সব শিশুই যেন নিরাপদে বেড়ে ওঠে।

ডা. এহসানুল কবীর
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights