সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

সীরাত পাঠের গুরুত্ব ও পদ্ধতি

সীরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা

সীরাত পাঠের গুরুত্ব কি । সিরাত কেন অধ্যয়ন করতে হবে ? সীরাতের জ্ঞানে মুসলমানদের অবস্থান কোথায়? যারা সীরাত পড়েন তারা কেন সীরাত থেকে ফায়দা পাচ্ছেন না? আমাদের সন্তানদের সীরাত শেখানোর গুরুত্ব। আমাদের সন্তানদের সীরাত শেখানোর কিছু টেকনিক। এই সব কিছু নিয়ে আজকে আমরা আলোচনা করবো 

সীরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা ?

মুসলমানদের ঈমান ও আকীদার সাথে সীরাত সম্পর্কযুক্ত :

ড. জামাল বাদাওয়ী বলেন ইসলামী স্কলার ড. রাজেহ আল-কুরদী বলেছেন, “সিরাহ মুসলিমদের ঈমান ও আকীদার সাথে সম্পর্কযুক্ত। কারণ মুসলিমদের আকীদা দুইটি বিষয়ের সাথে যুক্ত

(১) আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই
(২) মুহাম্মাদ ﷺ সাঃ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

মুহাম্মাদ ﷺ সাঃ কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে, তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়া। এই স্বীকৃতি তাঁর জীবনী, শিক্ষা ও পথ প্রদর্শনকে অধ্যয়নের নির্দেশ করে, দাবি করে। কারণ একজন ব্যক্তি এভাবেই আল্লাহর রাসূলের উদাহরণ দেখে আল্লাহর ইবাদাতের সব কিছুকে বাস্তবায়ন করে। এজন্যই আল্লাহ তাকে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বলে উল্লেখ করেছেন”।

পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচতে সীরাত জানতে হবে :

বিদায় হজ্জ্বে রাসূল ﷺ বলেছিলেন… ‘‘তোমরা কষ্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না, যদি এই দুটি জিনিসকে দাত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরো। তাহলো আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত”। এই হাদিসে আল্লাহর কিতাব তথা কুরআনের পর আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে। সুন্নাত শব্দের অর্থ আদর্শ। সুন্নাত শব্দের অর্থ জীবনাদর্শ । এই আদর্শ আমরা পাবো সীরাতে ও হাদিসে।

সীরাত না জানার পরিনাম মুহাম্মাদ ﷺ সাঃ এর শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া :

যারা প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর সীরাত জানে না, কুরআন ও হাদিস পড়ে না, তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন ধরণের বেদাতে লিপ্ত হয়। হাশরের ময়দানে বেদাতীরা প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে l প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর কোনো উম্মত তার সুপারিশ ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না। হাশরের ময়দানে সবাই যখন মুহাম্মদ ﷺ এর সুপারিশের জন্য অপেক্ষমান থাকবে। তখন ফেরেশতারা কিছু লোকদের ব্যাপারে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে বলবেন যে, এই লোকগুলো আপনার মৃত্যুর পর আপনার দ্বীনে নতুন নতুন পন্থা (বিদাআত) চালু করেছিল। তখন প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন।

আখেরাতে মুক্তির জন্য সীরাত জানতে হবে :

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا

“তোমাদের জন্য অবশ্যই রাসূল ﷺ এর মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে। যারা আল্লাহকে ও আখিরাতকে কামনা করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ করে”। [সূরা আহযাব : ২১ ]

আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ তায়ালা তার সাক্ষাত ও আখিরাতের আকাঙ্ক্ষাকে রাসূল ﷺ এর জীবনের আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন । এ থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ এর জীবনীকে এবং এর আদর্শকে এত বিশাল গুরুত্ব দিলেন। যে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁর সাক্ষাত ও আখিরাতের মুক্তি মুহাম্মাদ ﷺ এর জীবনী জানা ও মানার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

সীরাতের জ্ঞানে মুসলমানদের অবস্থান কোথায়?

কয়েকটা ক্ষেত্র থেকে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ১. পরিবার থেকে। ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে । ৩. মসজিদ বা আলেম-উলামা থেকে। আসুন আমরা এই তিনটি ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করে দেখি।

পরিবারে সীরাতের শিক্ষা :

আমরা কয়জন পিতামাতা প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনী জানি। আর যারা জানি তারা আমাদের সন্তানদের তা শিখিয়েছি কিনা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীরাত :

স্কুল-কলেজ থেকে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর সীরাত জানার সুযোগ খুব কম। কারণ পাঠ্যপুস্তকে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর সীরাত এর আলোচনা এতো কম যে, তা চোখে না পড়ার মতো। আর শিক্ষকদের অধিকাংশই প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর সীরাত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন না। কারণ তারাও এই শিক্ষাব্যাবস্থা থেকেই শিক্ষিত হয়েছেন।

মসজিদ বা আলেম – উলামাদের থেকে শেখা :

মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে, আলেম-উলামা-ইসলামিক স্কলারদের কাছ থেকে সীরাত শেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও সিরাতুন্নবী ﷺ মাহফিল ও ইউটিউবের মাধ্যমে সীরাত শেখার সুযোগ রয়েছে। তবে বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় সেগুলো যথেষ্ট নয়।

পড়েও কেন ফায়দা পাচ্ছেন না ?

যারা প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জীবনী পড়েন, লেকচার শুনেন তাদের মধ্যে আবার অনেকেই তা থেকে লাভবান হতে পারছেন না। এর কিছু কারণ রয়েছে –

১. যখন প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জীবনী পড়া হয়, তখন মনে করা হয় যে নিছক একটা জীবনী পড়ছি। ইতিহাসের একটা বই পড়ছি বা প্রাচীন কালের একটা রূপকথা পড়ছি।

২.যারা প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনী লিখেছেন বা তার জীবনীর উপর লেকচার দিয়েছেন। তাদের উপস্থাপনা কৌশলে ঘাটতি থাকা।

৩. প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে অতিমানব বা মহামানব মনে করা। যেমন কিছু লোক মুহাম্মদ সাঃ কি মাটির তৈরী নাকি নূরের তৈরী এটা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কিছু লোক বলেন, তিনি তার মায়ের গৰ্ভ থেকে দুনিয়ায় আসেননি। মায়ের বাম পাঁজরের হাড়ের মাঝ থেকে বের হয়েছেন। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি যারা পোষণ করেন, তারা মনে করেন যে, তারা মুহাম্মদ ﷺ কে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করছেন। আর এই শ্রেণীর লোকেরা মূলত আবেগ তাড়িত হয়ে এই সব কথা বলে থাকেন। এই আবেগ, এই দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গির খেলাফ ও হেকমতের খেলাফ।

বিভ্রান্তির বেড়াজাল

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো মুহাম্মদ ﷺ কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা দেয়। তাকে অতিমানব বা মহামানব মনে করা হয় তখন মনের মধ্যে এই ধারণা পোষণ করা হয়। যেমন আমাদের মতো মানুষদের সংসার-সন্তান, খাওয়া-দাওয়া, আয়- রোজগার, বাজার-ঘাট, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি ঝামেলা মুক্ত।  আমাদের মতো মানুষদের পক্ষে প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা এর মতো মহামানবকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। বাস্তবিক উপরোক্ত অতি আবেগী লোকদের দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন। তারা ব্যাক্তি জীবনে ও পারিবারিক জীবনে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর আদর্শ খুব কমই অনুসরণ করেন।

আমাদের সন্তানদের সীরাত শেখানোর গুরুত্ব :

أَدِّبُوا أولادَكم على ثلاثِ خِصَالٍ: حُبُّ نبيِّكم، وحُبُّ أهلِ بيتِه، وقراءةُ القرآنِ، فإنَّ حَمَلةَ القرآنِ في ظِلِّ اللهِ يومَ القيامةِ، يومَ لا ظِلَّ إلا ظِلُّه، مع أنبيائِه وأصفيائِه

তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও: ১. তোমাদের নবীর প্রতি ভালবাসা। ২. তাঁর পরিবারের প্রতি ভালবাসা। ৩. কোরআন তেলাওয়াত।  নিশ্চয়ই কোরআন বহনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়াতলে ছায়া থাকবে। যেদিন সেখানে তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তাঁর নবী এবং তাঁর পবিত্র লোকদের সাথে। [যয়ীফ, আল জামেউস সগীর : ২৫১]

অর্থাৎ তাদের সন্তানদেরকে গড়ে তুলার জন্য সীরাত ও কুরআন শিক্ষা দিতেন। এটাই ছিল তাদের ইসলামী সিলেবাস।

 সন্তানদের সীরাত শেখানোর টেকনিক :

১. সীরাত কে উপস্থাপনা করতে হবে শ্রোতা বা অডিয়েন্সের কথা বিবেচনা করে। যেমন একটা শিশুর সামনে গুরুগম্ভীর ভাব না নিয়ে অনেকটা গল্পচ্ছলে তুলে ধরতে হবে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনী। প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য রাহমাত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি ছোটদের অনেক আদর করতেন। তিনি আমাদের জান্নাতে যেতে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। তিনি গরিবদের, অসহায়দের, ইয়াতীমদের, মজলুমদের ভালোবাসতেন, সাহায্য করতেন। শত্রূদের জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

২. পিত-মাতা উভয়কে সীরাত সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। ভাসাভাসা জ্ঞান থাকলে হবে না। কারণ আপনাকে আপনার সন্তানের সামনে সুন্দর ও সাবলীল ভাবে সীরাত উপস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি ইসলামের শত্রূরা প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর উপর বিভিন্ন ধরণের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। আপনার সন্তান তার শিক্ষক বা তার বন্ধুদের কাছ থেকে এই নেতিবাচক কথাগুলো শুনে থাকতে পারে। আপনাকে তার সঠিক ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে।

৩. ইমাম সাহেব, আলেম-উলামার সাহচর্যে নিয়ে যাওয়া, মসজিদে নিয়ে যাওয়া, জুমার নামাজে নিয়ে যাওয়া, সীরাত বিষয়ক মাহফিলে নিয়ে যাওয়া , সীরাত বিষয়ক কার্টুন ,সীরাত বিষয়ক মুভি দেখার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন, যাতে আমরা মুহাম্মদ ﷺ এর সীরাত নিজেরা জানতে পারি, আমাদের সন্তানদের জানানোর ব্যবস্থা করতে পারি, দুনিয়ায় মুহাম্মদ ﷺ কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে হাশরের ময়দানে তার সুপারিশ পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারি।

মহিউদ্দিন মাসুম
ইমাম ও খতিব : বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights