সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ছয়টি হক – ৪র্থ পর্ব

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ

يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ

وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ

অর্থ: আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক হল ছয়টি। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে, মারা গেলে তার জানাযায় হাযির হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দিবে, যখন সাক্ষাৎ হবে তখন তাকে সালাম বিনিময় করবে, হাঁচি দিলে তার জওয়াবে দু’আ করবে এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত সকল সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। ( সূনান আত তিরমিজী: ২৭৩৭, মান-সহীহ)

এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ছয়টি হক: ৪র্থ পর্ব

وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ

অর্থাৎ যখন যে (অন্য মুমিনের সাথে) সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম দিবে। সালাম অত্যন্ত সহজ ও অন্যের জন্য কল্যাণ কামনামূলক একটি সম্ভাষণ। আর ইসলামী সংকৃতিতে সম্ভাষণের একমাত্র মাধ্যম হলো সালাম বিনিময় করা। সালাম এমন একটি সম্ভাষণ যার মাধ্যমে সুখে দুঃখে, হাসি-কান্নায় সকল অবস্থায় একজন মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করা বিদ্যামন।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সম্ভাবষণ:

প্রথমত:

সালাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিভিন্ন সম্ভাষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যা ইসলামী সম্ভাষণের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। কারণ এইসকল সম্ভাষণে না আছে কল্যাণ কামনা, আর না আছে কোন দুআ। যেমন: হিন্দু ধর্মের “নমস্কার”। নমস্কার শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত। যার অর্থ হলো অভিবাদন করা, নত হওয়া, প্রণাম করা [উইকেপিডিয়া]। পরিভাষায়,  With my head and heart I salute the God in you. অর্থাৎ আপনার অন্ত:স্থ ইশ্বরকে আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করছি ও সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ তার কাছে মাথা নত করে প্রণতি জ্ঞাপন করছি।  [১৯৩৩ সালে আমেরিকায় দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে প্রদত্ত ভাষনে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী এই অর্থ করেন।[ 

এখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট:

১. হিন্দুরা এই বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিদ্যমান। যা ইসলামী আকিদার পরিপন্থী। কারণ ইসলামী আকিদা হলো- আাল্লাহ তায়ালা আরশেই সমাসীন। [ সূরা ত্বহা:-০৫]

২. এই সম্ভাষনে ব্যক্তির জন্য কোন কল্যাণকামনা নেই বরং একজন মানুষ অন্য মানুষের নিকট গোলামীর স্বীকৃতি রয়েছে।  অথচ ইসলামের আগমনই হয়েছে মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে বের করে স্রষ্টার গোলামীর দিকে নিয়ে যাওয়া।

৩. নমস্কার শব্দের অর্থের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যে, শুধুমাত্র বড়রাই সম্ভাষণ বা salute পাবে, ছোটরা নয়। কারণ salute শব্দটি অধস্থন নয় বরং উর্ধতনদের জন্য ব্যবহার হয়।  অথচ সালাম ছোট বড়, ধনী-গরীব, উর্ধতন-অধস্থন  সকলের জন্য প্রযোজ্য।

৪. দুঃখের সময় আপনি যাকে নমস্কার বললেন, তাহলেতো তিনি ও তার সাথে থাকা ইশ্বরও দুঃখে রয়েছেন। যা অযৌক্তিও বটে।

দ্বিতীয়ত:

আমাদের সমাজে কিছু ধর্ম বিদ্ধেষী তথা নাস্তিক শ্রেণীর কিছু মানুষ Good Morning, (শুভ সকাল) ,Good Evening (শুভ সন্ধা), Good Night (শুভ রাত্রি) ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সম্ভাষণ প্রকাশ করে। এটি সকলের নিকট স্পষ্ট যে সময় কখনো নিজে নিজে কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে আসতে পারেন। অথচ এই মানুষগুলো স্বীকারই করে না যে, কোন এক সত্তা আছেন যিনি কিনা অদৃশ্য থেকে এই সময়গুলোর ভালো মন্দ নিয়ন্ত্রন করেন।

দেখুন একজন মানুষ যাকে আপনি Good Night (শুভ রাত্রি) বলে বিদায় দিয়েছেন তারপর সারা রাত শান্তিতে ঘুমিয়েছেন কিন্তু যখন সকালে তার ঘুমেই ভাঙ্গলো এই খবর শুনে যে, গতরাতে আগুন লেগে তার দোকান পুড়ে ছাই! তখন আপনি তাকে ফোন দিয়ে বা সরাসরি দেখা হলে কি বলবেন? Good Morning, (শুভ সকাল)? যে কিনা জানে গতরাত ও আজ সারাদিন তার উপর কেমন অশান্তি অতিবাহিত হয়েছে এবং হবে। অথচ ইসলামী সম্ভাষণ যা সর্বসময়ে সকল মানুষের জন্য উপযোগী। السلام عليكم ورحمة الله وبركاته (আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু) অর্থাৎ আপনার প্রতি আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বারাকহ অবতীর্ণ হোক। আবার যাকে সলাম দেওয়া হয় তিনি বলেন, وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته ( ওয়ালাইকুমুস সলাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু) অর্থাৎ আপনার প্রতিও আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বারাকহ অবতীর্ণ হোক। একটু লক্ষ করলে স্পষ্ট হবে যে, সালাম এমন  একটি সম্ভাষন যাতে সুখী-দু:খী, ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকলের জন্য থাক স্রষ্টার নিকট কল্যাণ কামনা থাকে।

তৃতীয়ত:

 আমাদের সমাজে আরো কিছু সম্ভাষণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা আমাদের বখে যাওয়া যুব সমাজ খুব আনন্দের সাথে ব্যবহার করে। যেমন: হায়! হ্যালো! স্কিউজমি! ইত্যাদি। যা কয়েকটি শব্দ বা আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সুতরাং ইসলামী সম্ভাষণই পরিপূর্ণ ও শাশ্বত। তাই আসুন আমরা পরিচিত অপরিচিত সকলকে সম্ভাষণে সালাম বিনিময় করি।

ইসলামে সালামের অবস্থান:

প্রিয় বাক্য:

ইসলামে সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর অন্যতম হলো সালাম বিনিময় করা। রাসূল (স.) কে যখন ইসলামের সবচেয়ে প্রিয় কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلاً، سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الإِسْلاَمِ خَيْرٌ قَالَ ‏ “‏ تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ

এক ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে আরয করল যে, কোন ইসলাম উত্তম (অর্থাৎ ইসলামের সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি লোকদের পানাহার করাবে এবং সালাম দিবে, তোমার পরিচিত কিংবা অপরিচিত যেই হোক না কেন। [সহীহ মুসলিম, ইফা : ৬৭]

সালাম আল্লাহর সম্ভাষণ:

সালাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালার সম্ভাষণ। জান্নাতীদের লক্ষ করে সালাম প্রদান করবেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন,

سَلٰمٌ ۟ قَوۡلًا مِّنۡ رَّبٍّ رَّحِیۡمٍ

অর্থ : পরম দয়ালু রবের পক্ষ থেকে সালাম, (সাদর সম্ভাষণ বা নিরাপত্তা)। [সূরা ইয়াসীন : ৫৮]

হাদীসে এসেছে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা খাদিজা (রা:) কে দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় সালাম পাঠিয়েছেন। হাদীসে এসেছে

أَتَى جِبْرِيلُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذِهِ خَدِيجَةُ قَدْ أَتَتْكَ مَعَهَا إِنَاءٌ فِيهِ إِدَامٌ أَوْ طَعَامٌ أَوْ شَرَابٌ فَإِذَا هِيَ أَتَتْكَ فَاقْرَأْ عَلَيْهَا السَّلاَمَ مِنْ رَبِّهَا عَزَّ وَجَلَّ وَمِنِّي وَبَشِّرْهَا بِبَيْتٍ فِي الْجَنَّةِ مِنْ قَصَبٍ لاَ صَخَبَ فِيهِ وَلاَ نَصَبَ ‏.‏

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জিবরীল (আলাহিস সালাম) এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই তো খাদীজা আপনার কাছে একটা পাত্র নিয়ে আসছেন, যারা মধ্যে কিছু তরকারি, খাদ্য ও পানীয় রয়েছেন। তিনি যখন আপনার কাছে আসবেন তখন তাকে তার পালনকর্তার এবং আমার পক্ষ হতে সালাম দিবেন। আর তাঁকে জান্নাতের একটি ঘরের সুসংবাদ দিবেন, যা এমন একটি মুক্তা দিয়ে তৈরি, যার ভিতর খোলা। যেখানে কোন হৈচৈ আর দুঃখ-কষ্ট নেই। [সহীহ মুসলিম, ইফা: ৬০৫৫]

সালাম জান্নাতীদের সম্ভাষণ:

 خَالِدِينَ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ ۖ تَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ

সেখানে তারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে স্থায়ী হবে, সেখানে তাদের অভিবাদন হবে সালাম। [সূরা ইবরাহীম:

সালাম মুমিনের মাঝে ভালোবাসার নিদর্শন :

রাসূল (স.) সালামকে এতো বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন যে, তিনি সালামকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তিনি বলেন

لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا ‏.‏ أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ

অর্থ : তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষন না ঈমান আনবে আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষন না একে অন্যকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বাতলে দেব না যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসার সৃষ্টি হবে? তা হল, তোমরা পরস্পর বেশি সালাম বিনিময় করবে। [সহীহ মুসলিম, ইফা: ১০০, আবু দাউদ, ইফা : ৫১০৩]

 

কখন সালাম বিনিময় করবে?

১. সাক্ষাতেই সালাম:

একজন মুমিনের সাথে অন্য মুমিনের যখনই সাক্ষাত হবে তখনই সালাম বিনিময় করবে।  রাসূল (স.) বলেন,

حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ ‏”‏ ‏.‏ قِيلَ مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏”‏ إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَسَمِّتْهُ وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ

মুসলমানের প্রতি মুসলমানের হক ছয়টি। জিজ্ঞাসা করা হল, সেগুলো কী, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইরশাদ করলেন (সেগুলো হলোঃ) ১. তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হলে তাকে সালাম করবে, ২. তোমাকে দাওযাত করলে তা তুমি গ্রহণ করবে, ৩. সে তোমার কাছে সৎ পরামর্শ চাইলে, তুমি তাকে সৎ পরামর্শ দিবে, ৪. সে হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে, তার জন্য তুমি (ইয়ারহামুকাল্লাহ বলে) রহমতের দুআ করবে, ৫. সে অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রুষা করবে এবং ৬. সে মারা গেলে তার (জানাযার) সঙ্গে যাবে। [সহীহ মুসলিম, ইফা: ৫৪৬৬, সূনান আত তিরমিজী: ২৭৩৭]

অন্য হাদিসে এসেছে,

إن المؤمن إذا لقي المؤمن فسلم عليه وأخذ بيده فصافحه تاثرت خطاياهما كما يتناثر ورق الشجر

অর্থ : নিশ্চয়ই একজন মুমিন যখন অন্য মুমিনের সাথে সাক্ষাত করবে তখন সালাম বিনিময় করবে এবং তার হাত ধরে মুসাহাফা করবে। তাহলে তাদের উভয়ের গোনাহ এমনভাবে ঝরে যাবে যেমন গাছের পাতা ঝরে যায়। [ আলবানী, সহীহ আত তারগীব-২৭২০]

২. আগে সালাম পরে কালাম:

কথা বলার শুরুতেই সালাম বিনিময় করতে হবে। রাসূল (স.) বলেন,

السَّلاَمُ قَبْلَ الْكَلاَمِ ‏

কালাম (কথাবার্তা) এর আগে সালাম। [ যয়ীফ, সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৬৯৯; হাসান, মিশকাতুল মাসাবীহ: ৪৬৫৩]

৩. ঘরে প্রবেশের পূর্বে সালাম:

কারো ঘরে প্রবেশের পূর্বে সালাম প্রদান করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে তার অধিবাসীদের সম্প্ৰীতিসম্পন্ন অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না করে প্ৰবেশ করবে না।এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ কর।  [সূরা আন নূর : ২৭]

রাসূল (স.) তার একান্ত খাদেম আনাস (রা.) কে বলেন, 

يَا بُنَىَّ إِذَا دَخَلْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُونُ بَرَكَةً عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ

হে বৎস, যখন পরিবার-পরিজনের নিকট প্রবেশ করবে তখন সালাম দিবে; এতে তোমার এবং তোমার গৃহবাসীর জন্য বরকত হবে। [যঈফ, সূনান তিরমিজী, ইফা: ২৬৯৫]

৪. মজলিসে আগমন ও গমনকালে

মজলিসে আগমন করলে উপস্থিত লোকদের সালাম প্রদান করবে এবং মসলিস থেকে গমনকালে বা সাক্ষাত শেষে ফিরে যাওয়ার সময়ও সালাম বিনিময় করবে। রাসূল (স.) বলেন,

إِذَا انْتَهَى أَحَدُكُمْ إِلَى مَجْلِسٍ فَلْيُسَلِّمْ فَإِنْ بَدَا لَهُ أَنْ يَجْلِسَ فَلْيَجْلِسْ ثُمَّ إِذَا قَامَ فَلْيُسَلِّمْ فَلَيْسَتِ الأُولَى بِأَحَقَّ مِنَ الآخِرَةِ

অর্থ : যখন তোমাদের কেউ মজলিসে পৌঁছবে তখন যেন সে সালাম করে। এরপর যদি তার সেখানে বসতে ইচ্ছে হয় তবে বসবে। পরে যখন উঠে দাঁড়াবে তখনও সে যেন সালাম দেয়। শেষেরটির চাইতে প্রথমটি বেশী উপযুক্ত নয়।

ছোটদের প্রতি সালাম:

সালাম এমন একটি সম্ভাষণ যা ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ছেলে বাবা-মাকে, বাবা-মা ছেলেকে দিতে পারবে। কারণ সালাম বিনিময় দ্বারা নতি স্বীকার করা বুঝায় না, বরং দুআ করা বুঝায়। তাছাড়া যে আগে সালাম দিবে সেই আল্লাহর নিকট প্রিয়। রাসূল (স.) বলেন,

إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللَّهِ مَنْ بَدَأَهُمْ بِالسَّلاَمِ

মহান আল্লাহ্‌র কাছে সে ব্যক্তি শ্রেয়, যে আগে সালাম দেয়। [সূনান আবু দাউদ, ইফা: ৫১০৭]

তাছাড়া রাসূল (স.) নিজেও শিশুদের সালাম প্রদান করতেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইয়াসার (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنْتُ أَمْشِي مَعَ ثَابِتٍ الْبُنَانِيِّ فَمَرَّ عَلَى صِبْيَانٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ فَقَالَ ثَابِتٌ كُنْتُ مَعَ أَنَسٍ فَمَرَّ عَلَى صِبْيَانٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ وَقَالَ أَنَسٌ كُنْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَرَّ عَلَى صِبْيَانٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ ‏.‏

অর্থ: তিনি বলেনঃ আমি ছাবিত বুনানী (রহঃ) এর সঙ্গে চলছিলাম। একদল শিশুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তাদের সালাম দিলেন। ছাবিত (রহঃ) বলেন, আমি একবার আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সঙ্গে ছিলাম। শিশুদের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রমের সময় তিনি তাদের সালাম দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। শিশুদের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম কালে তিনিও তাদের সালাম করেছিলেন। [সূনান তিরমিজী, ইফা: ২৬৯৬]

কে কাকে সালাম দিবে?

প্রথমত প্রত্যেক মুমিন অপর মুমিনে সাক্ষাতে আসলেই সালাম দিবে। তবে যিনি আগে সালাম দিবেন তার মর্যাদা পরে সালাম প্রদানকারী ব্যক্তির চেয়ে অধিক। উসামা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ  الرَّجُلاَنِ يَلْتَقِيَانِ أَيُّهُمَا يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ فَقَالَ ‏ “‏ أَوْلاَهُمَا بِاللَّهِ ‏

আবূ উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! দুই ব্যক্তি সামনা-সামনি হলে কে প্রথম সালাম দিবে? তিনি বললেনঃ যে তাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার (রহমতের) অধিক নিকটবর্তী সে। [সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৬৯৪]

কিন্তু রাসূল (স.) এর অন্যান্য হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয় যে, আরোহী ব্যক্তি পথচারীকে, পথচারী ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে, কম সংখ্যকক বেশি সংখ্যককে এবং ছোটরা বড়দের সালাম দিবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (স.) বলেন,

يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى الْمَاشِي وَالْمَاشِي عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ ‏”‏ ‏.‏ وَزَادَ ابْنُ الْمُثَنَّى فِي حَدِيثِهِ ‏”‏ وَيُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ

আরোহী ব্যক্তি সালাম দিবে পথচারী ব্যক্তিকে; পথচারী ব্যক্তি সালাম দিবে বসে থাকা ব্যক্তিকে; কম সংখ্যক সালাম দিবে বেশী সংখ্যককে। ইবন মুছান্না (রহঃ) তাঁর রিওয়ায়তে আরো বর্ণনা করেনঃ অল্পবয়স্ক সালাম দিবে বয়স্ককে। [সূনান আত তিরমিজী, ইফা : ২৭০৩]

অন্য হাদীসে বলেন,

يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ

অল্প বয়স্ক বয়স্ককে, পথ অতিক্রমকারী উপবিষ্টকে, কমসংখ্যক বেশী সংখ্যককে সালাম দিবে। [ সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৭০৪]

সালাম প্রদানে নিষেধাজ্ঞাসমূহ:

১. অমুসলিমদের সালাম দেওয়া নিষেধ:

ইসলাম সকল ধর্মের মানুষের জন্যই কল্যাণ কামনা করার অনুমোদ করে, উৎসাহ দেয়। কিন্তু সালাম শুধুমাত্র কল্যাণ কামনা নয় বরং তা একটি ইবাদতও। তাই রাসূল (স.) অমুসলিমদের প্রথমে সালাম প্রদানে নিষেজ্ঞারোপ করেছেন। রাসূল (স.) বলেন,

لاَ تَبْدَءُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى بِالسَّلاَمِ

ইয়াহূদ ও নাসারাকে প্রথমে সালাম দিবে না। [সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৭০০]

কিন্তু মুসলিম ও অমুসলিমগণ যদি কোন এক স্থানে একত্রে সমবেত হয় তবে মুসলিমদের ‍উদ্দেশ্য সালাম বিনিময় করতে হবে। হাদীসে এসেছে,

أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم مَرَّ بِمَجْلِسٍ وَفِيهِ أَخْلاَطٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَالْيَهُودِ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এমন এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যেখানে মুসলমান ও ইয়াহূদী লোকজন মিশ্রিত ছিল। তিনি তাদের প্রতি সালাম দিলেন। [সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৭০২]

তবে কোন অমুসলিমের বাড়িতে প্রবেশের সময় অথবা তার নিকট কোন পত্র প্রেরণ বা কোন চুক্তি সম্পাদনে সালাম দেয়া যেতে পারে। রাসূল (স.) কর্তৃক বাদশা হিরাকলকে প্রেরিত ঠিটিতে তিনি এমনই করেছিলেন। রাসূল (স.) চিঠিতে লেখেন,

“‏ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللَّهِ إِلَى هِرَقْلَ عَظِيمِ الرُّومِ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى

অর্থ: দয়াবান দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে! এটা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে রোমের প্রধান ব্যক্তি হিরাকল এর প্রতি। সালাম সেই ব্যক্তির উপর, যিনি (হিদায়াতের) সঠিক পথ অনুসরন করেন। [ সহীহ মুসলিম, ইফা: ৪৪৫৬, আবু দাউদ, ইফা: ৫০৪৬]

২. ইশারায় সালাম:

হাত তুলে বা ইশারায় সালাম দেয়া মাকরুহ বা নিন্দনীয়। রাসূল (স.) বলেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لاَ تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ وَلاَ بِالنَّصَارَى فَإِنَّ تَسْلِيمَ الْيَهُودِ الإِشَارَةُ بِالأَصَابِعِ وَتَسْلِيمَ النَّصَارَى الإِشَارَةُ بِالأَكُفِّ

অর্থ: যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া বিজাতীয়দের অনুসরণ করে সে আমার উম্মত নয়। তোমরা ইয়হূদ ও নাসারার অনুকরণ করবে না। ইয়াহূদীদের সালাম হল অঙ্গুলির ইশারা করা আর নাসারার সালাম হল হাতের তালুর ইশারা করা। [সূনান আত, ইফা: ২৬৯৫]

তবে দুরের কোন ব্যক্তিকে সালাম বিনিময় বুঝাতে ইশারা করা জায়েজ। আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ فِي الْمَسْجِدِ يَوْمًا وَعُصْبَةٌ مِنَ النِّسَاءِ قُعُودٌ فَأَلْوَى بِيَدِهِ بِالتَّسْلِيمِ وَأَشَارَ عَبْدُ الْحَمِيدِ بِيَدِهِ

অর্থ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন মসজিদের ভিতর হেঁটে যাচ্ছিলেন। একদল মহিলা সেখানে উপবিষ্ট ছিল। তখন তিনি সালামের সঙ্গে তাঁর হাত দিয়ে ইশারা করলেন। [সহীহ, সূনান আত তিরমিজী, ইফা: ২৬৯৭]

আলোচ্য হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, শুধুমাত্র ইশারা করা সালাম নয় বরং সালামের বাক্য বলে ইশারা জায়েজ।

৩. কদমমুছি

এখন প্রশ্ন হলো কদমমুছি জায়েজ কিনা? প্রথমত কদমমুছি কোন সালাম নয় বরং তা আদবের বহি:প্রকাশ। কেননা রাসূল (স.) থেকে এমন কোন সুন্নাহ প্রমানিত নয়। তাছাড়া তার কন্যা ফাতেমা (রা.) সহ কোন সাহাবী সালামের উদ্দেশ্যে রাসূল (স.) এর কদমমুছি করেছেন বলে কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আর আমাদের সমাজে কদমমূছি এসেছে মূলত হিন্দু সংস্কৃতি থেকে। যা অনুসরণ করা হারাম। রাসূল (স.) বলেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لاَ تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ وَلاَ بِالنَّصَارَى فَإِنَّ تَسْلِيمَ الْيَهُودِ الإِشَارَةُ بِالأَصَابِعِ وَتَسْلِيمَ النَّصَارَى الإِشَارَةُ بِالأَكُفِّ

অর্থ: যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া বিজাতীয়দের অনুসরণ করে সে আমার উম্মত নয়। তোমরা ইয়হূদ ও নাসারার অনুকরণ করবে না। ইয়াহূদীদের সালাম হল অঙ্গুলির ইশারা করা আর নাসারার সালাম হল হাতের তালুর ইশারা করা। [সূনান আত, ইফা: ২৬৯৫]

এছাড়াও কদমমূছিতে শিরকের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তা থেকে বিরত থাকাই সর্বত্তম পন্থা।

সালাম প্রদানের নিষিদ্ধ সময়:

কোন ব্যক্তি যখন ইন্তেনজা তথা পেশাব পায়খানা রত থাকে তখন তাকে সালাম দেয়া ও তার উত্তর নেয়া জায়েজ নেই। ইবন উমার (রা.) থেকে একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلاً، سَلَّمَ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَبُولُ فَلَمْ يَرُدَّ عَلَيْهِ يَعْنِي السَّلاَمَ

অর্থ: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেশাব করছিলেন। এমতাবস্থায় এক লোক তাঁকে সালাম করল। তিনি তার সালামের জওয়াব দেননি। [ সূনান আত তিরমিজী, ইফা : ২৭২০]

উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজে অনেকে বলে থাকেন যে, খাবারের সময় সালাম দেয়া বা তার উত্তর দেয়া জায়েজ নেই। অথচ যাকে সালাম দেয়া হচ্ছে তিনি যদি খাবারে থাকেন, তখন সালামের উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন যে, আমি খাবারে আছি, তাই সালামের উত্তর সালামের উত্তর নিতে পারছি না। তিনি “আমি খাবারে আছি, তাই সালামের উত্তর সালামের উত্তর নিতে পারছি না” এ কথা বলতে পারলেন অথচ সালামের উত্তর দিতে পারেন নি। এটি সুন্নাহ সম্মত নয়। বরং উচিৎ হলো মুখের খাবার শেষ করে উত্তর দেয়।

 

সালামের উত্তর প্রদানে বিদআতের প্রচলন :

লক্ষণীয় যে, কখনো কখনো সালামের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা সুন্নাহ বহির্ভূত অতিরঞ্জিত উত্তর দিয়ে থাকি। যা স্পষ্ট বিদআত। যেমন কেউ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু বলে সালাম দেয়, তখন উত্তর দাতা উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু বাড়িয়ে বলে ‘ওয়া জান্নাতুহু, ওয়া নাজাতুহু, ওয়া হায়াতুহু, ওয়া মাগফিরাতুহু, ইত্যাদি। শব্দগুলো সুন্দর ও অর্থবোধক দুআ। কিন্তু এগুলো সালামের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাহ সম্মত নয়, কারণ রাসূল (স:) কখনো এমনটি করেননি।

লেখক,
হাফেজ মাওলানা নুরুল হুদা
খতিব, বাইতুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবিরহাট চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights