সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

২য় পর্ব: এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের যে ছয়টি হক

দারসুল হাদিস - এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের যে ছয়টি হক

 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ

يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ

وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ

অর্থ: আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক হল ছয়টি। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে, মারা গেলে তার জানাযায় হাযির হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দিবে, যখন সাক্ষাৎ হবে তখন তাকে সালাম বিনিময় করবে, হাঁচি দিলে তার জওয়াবে দু’আ করবে এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত সকল সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। ( সূনান আত তিরমিজী: ২৭৩৭, মান-সহীহ)

২য় পর্ব

জানাযায় অংশগ্রহণ ঈমানের অঙ্গ :

জানাযায় অংশগ্রহণ ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাকে রাসূল (স.) অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাসূল (স.) বলেন:

مَنِ اتَّبَعَ جَنَازَةَ مُسْلِمٍ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، وَكَانَ مَعَهُ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، وَيَفْرُغَ مِنْ دَفْنِهَا، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ مِنَ الأَجْرِ بِقِيرَاطَيْنِ، كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رَجَعَ قَبْلَ أَنْ تُدْفَنَ فَإِنَّهُ يَرْجِعُ بِقِيرَاطٍ

অর্থ:যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় কোন মুসলমানের জানাযায় অনুগমন করে এবং তার জানাযার সালাত আদায় ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সাথে থাকে, সে দুই কীরাত সওয়াব নিয়ে ফিরবে। প্রতিটি কীরাত হল উহুদ পর্বতের মতো। আর যে ব্যাক্তি শুধু জানাযা আদায় করে, তারপর দাফন সম্পন্ন হওয়ার আগেই চলে আসে, সে এক কীরাত সওয়াব নিয়ে ফিরবে। [সহীহ বুখারী, ইফা: ৪৫]

জানাযার পর লাশের সম্মান:

জানাযায় আগমনকারীগণ মায়্যেতকে কাঁদ থেকে নামিয়ে রাখা পর্যন্ত বসবে না। কেউ যদি কোন জানাযায় অংশগ্রহণ করে তবে সে লাশের অগ্রবর্তী হবে না বরং তার পিছনে চলবে, অনুরুপভাবে যে ব্যক্তি জানাযায়ও অংশগ্রহণ করতে পারেনি সে জানাযায় আগত লোকদের অগ্রবর্তী হবে না। বরং তাদের চলে যাওয়ার অপেক্ষা করবে। রাসূল (স.) বলেন-

إِذَا رَأَى أَحَدُكُمْ جَنَازَةً فَإِنْ لَمْ يَكُنْ مَاشِيًا مَعَهَا فَلْيَقُمْ حَتَّى يُخَلِّفَهَا، أَوْ تُخَلِّفَهُ أَوْ تُوضَعَ مِنْ قَبْلِ أَنْ تُخَلِّفَهُ ‏

অর্থ: তোমাদের কেউ জানাযা যেতে দেখলে যদি সে তার সহযাত্রী না হয়, তবে ততক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে ব্যাক্তি জানাযা পিছনে ফেলে, বা জানাযা তাকে পিছনে ফেলে যায়, অথবা পিছনে ফেলে যাওয়ার পূর্বে তা (মাটিতে) নামিয়ে রাখা হয়। [সহীহ বুখারী: ইফা ১২৩২]

আর যদি বসা ব্যক্তির সামনে দিয়ে কোন মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তখন দাড়িয়ে যাবে এবং লাশের সাথে আগত জানাযার লোকজন অতিক্রম হওয়া ব্যতিত বসবে না। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন

مَرَّ بِنَا جَنَازَةٌ فَقَامَ لَهَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَقُمْنَا بِهِ‏.‏ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّهَا جَنَازَةُ يَهُودِيٍّ‏.‏ قَالَ ‏ “‏ إِذَا رَأَيْتُمُ الْجَنَازَةَ فَقُومُوا ‏”‌‏.‏

অর্থ:, আমাদের পাশ ‍দিয়েয় একটি জানাযা যাচ্ছিল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরাও দঁড়িয়ে পড়লাম এবং আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো এক ইয়াহূদীর জানাযা। তিনি বললেনঃ তোমরা যে কোন জানাযা দেখলে দাঁড়িয়ে পড়বে। [বুখারী, ইফা: ১২৩৩]

এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, যে কোন ধর্মের মানুষের লাশের সম্মানে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা মুমিনের কর্তব্য। তাছাড়া এটি ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের উধারতা প্রমাণ করে। কিন্তু আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে, আমরা কোন লাশকে সম্মান প্রদর্শন করতে সুন্নাহ পরিপন্থী কোন কোন কাজ করে না বসি। যেমন: কবরে সিজদা দেওয়া, ফুল দেয়া, আলো প্রোজ্জ্বলন করা, কবরকে পাকা করা ইত্যাদি।

উল্লেখ্য যে, আমরা বর্তমান সমাজে দেখতে পাই, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রতিহিংসার কারণে লাশের গাড়িতে বা কফিনের প্রতি জুতা নিক্ষেপ করতে। কিছু ক্ষেত্রেতো দাফনকৃত লাশও উত্তোলন করে ফেলে দিতে দেখা যায়। যা অত্যন্ত ঘৃণিত ও অমানবিক এবং কবীরা গুনাহের কাজ। আল্লাহ সকলকে এমন গর্হিত কাজ থেকে হেফাজত করুন।

মৃত ব্যক্তির সৎগুণের আলোচনা :

জানাযায় অংশগ্রহণকারীগণ অথবা মৃত্যুর সংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উচিৎ মৃত ব্যক্তির জীবনে কৃত সৎকাজের আলোচনা করা এবং খারাপ কাজগুলো গোপন রাখা। এতে করে মৃত ব্যক্তির নাজাতের ব্যবস্থা ও জান্নাতে প্রবেশে সহায়ক হবে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আসওয়াদ (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-

قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ وَقَدْ وَقَعَ بِهَا مَرَضٌ، فَجَلَسْتُ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ فَمَرَّتْ بِهِمْ جَنَازَةٌ فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا خَيْرًا فَقَالَ عُمَرُ ـ رضى الله عنه ـ وَجَبَتْ‏.‏ ثُمَّ مُرَّ بِأُخْرَى فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا خَيْرًا، فَقَالَ عُمَرُ ـ رضى الله عنه ـ وَجَبَتْ‏.‏ ثُمَّ مُرَّ بِالثَّالِثَةِ، فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا شَرًّا فَقَالَ وَجَبَتْ‏.‏ فَقَالَ أَبُو الأَسْوَدِ فَقُلْتُ وَمَا وَجَبَتْ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ قَالَ قُلْتُ كَمَا قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ أَيُّمَا مُسْلِمٍ شَهِدَ لَهُ أَرْبَعَةٌ بِخَيْرٍ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ ‏”‌‏.‏ فَقُلْنَا وَثَلاَثَةٌ قَالَ ‏”‏ وَثَلاَثَةٌ ‏”‌‏.‏ فَقُلْنَا وَاثْنَانِ قَالَ ‏”‏ وَاثْنَانِ ‏”‌‏.‏ ثُمَّ لَمْ نَسْأَلْهُ عَنِ الْوَاحِدِ‏

আমি মদিনায় আসলাম, তখন সেখানে একটি রোগ (মহামারী আকারে) ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এর কাছে বসা ছিলাম। এ সময় তাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা অতিক্রম করল। তখন জানাযার লোকটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা হল। উমর (রাঃ) বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। এরপর অপর একটি (জানাযা) অতিক্রম করল, তখন সে লোকটি সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা হল।

(এবারও) তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। এরপর তৃতীয় একটি (জানাযা) অতিক্রম করল, লোকটি সম্বন্ধে নিন্দাসূচক মন্তব্য করা হল। তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। আবূল আসওযাদ (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আমীরূল মু’মিনীন! কি ওয়াজিব হয়ে গেল? তিনি বললেন, আমি তেমনই বলেছি, যেমন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, যে কোন মুসলমান সম্পর্কে চার ব্যাক্তি ভাল হওয়ার সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। [উমর (রাঃ)] বলেন, তখন আমরা বলেছিলাম, তিন জন হলে?

তিনি বললেন, তিনজন হলেও। আমরা বললাম, দু’জন হলে? তিনি বললেন, দু’জন হলেও। তারপর আমরা একজন সম্পর্কে আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করি নি। [সহীহ বুখারী, ইফা: ১২৮৪]

উল্লেখ্য যে, বর্তমানে এই হাদিসকে ব্যবহার করে একটি বিদআত চালু হয়েছে। সেটি হলো মৃত ব্যক্তিকে জানাযার সামনে জানাযায় আগত লোকদের কাছ থেকে এক প্রকার জোর এই স্বীকৃতি আদায় করা হয় যে লোকটি ভালো ছিলো। যেমন: জানাযার নামাজের শুরুতে এক ব্যক্তি বলবে, লোকটি কেমন ছিল? লোকটি কেমন ছিল?

লোকটি কেমন ছিল? সকলে উত্তর দিবে লোকটি ভালো ছিল। যা স্পষ্ট বিদআত এবং কখনো কখনো মিথ্যা সাক্ষ্যের পর্যায়েও পড়ে যায়। উল্লেখি হাদিসে মূলত যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, লোকজন স্বপ্রণোদিত হয়ে মায়্যেতের প্রশংসা করবে ও তার সৎগুনাবলীর আলোচনা করবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।

লেখক,হাফেজ মাওলানা নুরুল হুদা
খতিব, বাইতুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবিরহাট চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights