সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

“সিয়াম : ক্ষমা পাওয়ার এক সুবর্ণ ‍সুযোগ”

দারসূল হাদিস

সিয়াম: ক্ষমার ক্ষমা পাওয়ার এক সুবর্ণ ‍সুযোগ

(1) عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «من صام رمضان إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه، » (متفق عليه).

(2) عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «من قام رمضان إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه» (متفق عليه).

(১) হয়রত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: রাসূল স: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমজানের সিয়াম পালন করে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

(২) হয়রত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: রাসূল স: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমজানে কিয়ামুল্লাইল করে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

রাবী পরিচিতি:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয় সাহাবীদের মধ্যে আবু হুরায়রা রা. ছিলেন অন্যতম। তার জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তিনি সাহাবিদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস শুনেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা উপনাম। আর এ উপনামেই তিনি সমধিক পরিচিত। আবু হুরায়রা রা.-এর প্রকৃত নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তার ৬০টি পর্যন্ত নাম পাওয়া গেছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে নাম ছিল আবু শামছুর, আবু উমর, আবদুল লাজ ও আবদুল উজ্জা। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তার নাম রাখা হয়েছিল আবদুল্লাহ বা আব্দুর রহমান। আবু হুরায়রা নামটিতে একটি চমকপ্রদ কাহিনী জড়িত আছে। একদিন হযরত হুরায়রা রা. জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়াল নিয়ে রাসূল সা.-এর দরবারে হাজির হলে হঠাৎ বিড়ালটি সবার সামনে বেরিয়ে পড়ল। এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. রসিকতা করে তাকে ‘হে বিড়ালের প্রতিপালক’ বলে সম্বোধন করলেন। এরপর থেকে তিনি আবু হুরায়রা রা. বিড়ালের পিতা নামে খ্যাতি লাভ করেন।

আবু হুরায়রা দক্ষিণ আরবের আজদ গোত্রের সুলায়ম ইবনে ফাহাম বংশোদ্ভূত। হযরত আবু হুরায়রা রা. ৬২৮ খৃষ্টাব্দ অর্থাৎ সপ্তম হিজরিতে মুহররম মাসে খায়বারের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে প্রখ্যাত সাহাবি তুফায়িল ইবনে আমর আদ দাওসির কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৩০ বছরের মতো।

তিনি তিন বছর নবী মুহাম্মদ(সা:) এর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বহুসংখ্যক হাদীস আত্মস্থ করেন এবং বর্ননা করেন| হিসাব অনুযায়ী, ৫,৩৭৪ টি হাদীস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। বলা হত যে, উর্বর মস্তিষ্ক ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি| তাঁর কাছ থেকে আটশত তাবেঈ হাদীস শিক্ষা লাভ করেছিলেন|।  তিনি সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। ৬৭৭ খৃস্টাব্দে [৫৭ হিজরি] ৭৮ বছর বয়সে আবু হুরায়রা রা. ইহকাল ত্যাগ করে। আবু সুফিয়ান রা. তার যানাজায় ইমামতি করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাকে সমাহিত করা হয়।

মুত্তাফাকুন আলাইহি কি?

হাদিস শাস্ত্রে মুত্তাফিকুন আলাইহি বলতে বুঝায় যে হাদীসের বিষয়ে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম ঐক্যমত পোষন করেছেন। হাদিসের মানদন্ডে মুত্তাফিকুন আলাইহি হাদিসগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী।

হাদিসের ব্যাখ্যা:

আলোচ্য হাদিসদ্বয়ের প্রতি লক্ষ করলে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়।

প্রথমত: দুইটি হাদিসই রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজের কথা বর্ণিত হয়েছে। ১. দিনের বেলায় সিয়ামের সকল হুকুম আহকাম মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ কাজগুলো বর্জনের মাধ্যমে সিয়াম পালন করা। ২. ফরজ সালাতের পাশাপাশি নফল সালাত আদায় করা।

তৃতীয়ত: রমজানে যারা ঈমান ও ইহতেসাবের মাধ্যমে সিয়াম পালন করবে এবং সালাত আদায় করবে তাদের জন্য রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান স্বরুপ ক্ষমা। যা একজন মুমিনের সারা জীবনের আরাধ্য বিষয়।

এই তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখেই হাদিসটি ব্যাখ্যা করা হলো।

প্রথমত: রমজানের ফজিলত-

রমজানের সবচেয়ে বড় ফজিলত হলো এটি খোদাভীতি, পরহেজগারী ও তাকওয়ার মাস। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থ: হে ইমানদারগন! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্বেকার জাতীর উপর ফরজ করা হয়েছে। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা: ১৮৩) কাজেই মানুষের মাঝে আল্লাহ ভীতি সৃষ্টির লক্ষেই সিয়ামের বিধান ফরজ করা হয়েছে।

রমজান মাস আরবী অন্যান্য মাসের মতই একটি মাস। কিন্তু এই মাসটিকে মহিমান্বিত ও ফজিলতপূর্ণ  করা হয়েছে পবিত্র কুরআন নাযিলের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ

অর্থ: রমজান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে । আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক বাতিলের ) পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারা: ১৮৫)

আর রমজানে একটি বিশেষ রাত্র রয়েছে যাকে মুবারকময় রাত্রী বলা হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন:

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ

অর্থ: নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (সূরা দুখান:০৩)

এই মুবারকময় রাত্রিকে বলা হয় লাইলাতুল কদর। যাকে কুরআন হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলেছেন। পবিত্র কালামুল্লাহতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

অর্থ: নিশ্চয় আমরা কদরের রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছি। হে রাসূল আপনি কি জানেন কদরের রাত্রিটি কি? কদরের রাত্রিটি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত্রি। সে রাতে ফেরেশতা ও রুহ ( জিব্রাঈল আ) তাদের রবের নির্দেশক্রমে কল্যানের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। কল্যাণময় সে রাত! কল্যাণময় থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। (সূরা কদর: ১-৫)

উল্লেখিত আয়াতে কারিমাগুলো থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হলো রমজান মূলত সম্মানিত হয়েছে পবিত্র কুরআন নাযিলের মাধ্যমে এবং কদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলার কারণও হলো এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় ছোট্ট একটি কাঠ বা কাপড়ের টুকরা সীমাহীন সম্মানের হয় যখন তা কুরআনের সংস্পর্শে আসার কারণে। কাজেই মুসলিম জাতী যদি কুরআনের সংস্পর্শে এসে তাদের জীবনকে কুরআনের রঙে রঙিন করতে পারে তাহলে তারা হবে পৃথিবীর বুকে সম্মানিত।

এছাড়াও রমজানের আরো অনেক মর্যাদা রয়েছে যা রমজানকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। রাসূল (স:) ইরশাদ করেন:

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت أبواب النار وصفدت الشياطين

অর্থ: যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানকে শিকল বন্ধি করা হয়। (মুসলিম)

অন্য হাদিসে আরো বলেন:

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين، ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة، فلم يغلق منها باب

রমজানের প্রথম রাতে শয়তানকে ও অভিশপ্ত জিনকে শিকল বদ্ধ করা হয়,  জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় রমজানে আর খোলা হবে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় রমজানে আর বন্ধ করা হবে না।

সিয়াম পালনকারীগণ আল্লহ তায়ালার বিশেষ মেহমান। যার কারণে তাদের সম্ভাষণ জানানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছেন। জানানো হবে লাল গালিচার শুভেচ্ছা। রাসূলে কারীম স: বলেন:

إِنَّ فِي الجَنَّة بَابًا يُقَالُ لَهُ: الرَّيَّانُ، يدْخُلُ مِنْهُ الصَّائمونَ يومَ القِيامةِ، لاَ يدخلُ مِنْه أَحدٌ غَيرهُم، يقالُ: أَينَ الصَّائمُونَ؟ فَيقومونَ لاَ يدخلُ مِنهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فإِذا دَخَلوا أُغلِقَ فَلَم يدخلْ مِنْهُ أَحَدٌ

অর্থ: নিশ্চয় জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে বলা হয় রাইয়ান। কিয়ামতের দিন তা দিয়ে শুধু রোজাদারগন প্রবেশ করবে। রোজাদার ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা। বলা হবে রোজাদাররগন কোথায়? তারা দাঁড়াবে। তারা ছাড়া অন্য কেউ তাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। যখন তারা প্রবেশ করবে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে অতপর আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেনা। (বুখারী ও মুসলিম)

মুমিনের প্রতিটি আমলেই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তার সকল আমল থেকে রোজাকে আলাদা করে তার নিজের জন্য খাস করে নিয়েছেন। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قال الله عز وجل: كل عمل ابن آدم له إلا الصيام، فإنه لي وأنا أجزي به، والصيام جنة

আল্লাহ তায়ালা বলেন: বনী আদমের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য শুধুমাত্র সিয়াম ব্যতীত। নিশ্চয় তা আমার জন্য আমিই এর প্রতিদান দিব। (বুখারী ও মুসলিম)

তাছাড়া একজন ব্যক্তির কাছে যেমন তার প্রিয়তম ব্যক্তিটির সকল দোষ-ত্রুটি গৌন ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালার নিকট তার প্রিয় রোজাদারদের মুখের গন্ধ মেশকের চেয়েও অধিক প্রিয়। রাসূল স: ইরশাদ করেন:

والذي نفس محمد بيده، لخلوف فم الصائم أطيب عند الله، يوم القيامة، من ريح المسك

অর্থ: যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ সেই সত্তার শপথ! নিশ্চয়=-০ রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তায়ালার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয়। (বুখারী ও মুসলিম)

শুধু কি তাই! একজন মুসলমানের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওনা হলো তার রবের দিদার তথা সাক্ষাত। আশ্চর্য বিষয় হলো অন্য কোন আমলের ক্ষেত্রে রবের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি শুধুমাত্র রমজানই এর ব্যতিক্রম। আল্লাহর রাসূর স: বলেন: للصائم فرحتان فرحة عند فطره وفرحة عند لقاء ربه

অর্থ : রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ। একটি আনন্দ হলো যখন সে ইফতার করে অপরটি হলো যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাত করবে। (বুখারী)

হাদীসে উল্লেখিত দ্বিতীয় দিক :

রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতের এতো বিশাল মহত্তপূর্ণ ইবাদত নষ্ট বা হালকা হয়ে যায় আমাদের একটু অসচেতনতার কারনে। রাসূল স: এই কারনে ইরশাদ করেন:

رُب صائم ليس له من صيامه إلا الجوع، ورُب قائم ليس له من قيامه إلا السهر

অর্থ: কিছু রোজাদার আছে যার জন্য উপবাস ছাড়া আর কিছুই নেই, এমন কিছু সালাত আদায় কারী আছে যার জন্য রাত্রী জাগরণ ছাড়া আর কিছুই নেই। ( ইবনে মাজাহ)

রাসূল স: আরো ইরশাদ করেন:

من لم يدع قول الزور والعمل به، فليس لله حاجة في أن يدع طعامه وشرابه

অর্থ: যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ ছাড়তে পারেনি তার খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী)

কাজেই সিয়ামকে ত্রুটিপূর্ণ ও অক্ষত রাখতে হলে প্রয়োজন আত্মসংযোম ও আত্মউপলব্ধি। তাই রোজাদারের উচিৎ তার সিয়ামকে পরিপূর্ণ করতে রাসূল স: এর শিখানো পদ্ধতির অনুসরণ। রাসূল স: বলেন:

فإذا كان يوم صوم أحدكم، فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله، فليقل: إني امرؤ صائم،

যখন তোমাদের কেউ দিনের বেলা রোজা রাখে, সে যেন অশ্লীল কাজ ও ঝগড়া বিবাদ থেকে দুরে থাকে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা ঝগড়া করে সে যেন তাকে বলে আমি রোজাদার। (বুখারী ও মুসলিম)

রমজান নামক এই মেহমানের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব আরো বহুগুণে বেড়ে যাবে যদি আমরা ফরজ ইবাদতের পাশা-পাশি নফল ইবাদত করতে পারি। রাসূল স: এই কারনেই বলেছেন:

من قام رمضان إيمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه

অর্থ: যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমজানে কিয়াম তথা সালাত আদায় করে তার পূর্বের সকল গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।(বুখারী ও মুসলিম) ।

এমন অনেক রোজাদার আছেন যারা সারাদিন উপোস থেকে সিয়াম পালন করে কিন্তু দু:খের বিষয় হলো নফল সালাততো দুরের কথা আমরা ফরজ সালাতও কাযা করে ফেলি। কাজেই রমজানের ফায়দা হাসিল করতে হলে ফরজ সালাতের পাশা-পাশি সালাতুত তারাবী ও কিয়ামুল লাইল করতে হবে। তারাবীর সালাতের রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তারাবী সুন্নাত এই বিষয়ে সকলেই একমত। তাই রাকাত নিয়ে বিতর্ক না করে যথক্ষণ সম্ভব কিয়ামুল্লাইল করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করতে হবে।

উল্লেখিত হাদিসদ্বয়ের তৃতীয় দিক হলো: মাগফিরাত ও নাজাত। কোন রোজাদার যখন  ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে সিয়াম পালন করে এবং নফল ইবাদত তথা তারাবীহ, তাহাজ্জুদ আদায় করে তার জন্য জন্য রয়েছে মহান রবের পক্ষ থেকেমাগফিরাত ও নাজাত । এই দিকে ইঙ্গিত করে রাসূল স: ইরশাদ করেন:

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب، وينادي مناد يا باغي الخير أقبل ويا باغي الشر أقصر، ولله عتقاء من النار وذلك كل ليلة
অর্থ:যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর  হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো (তিরমিযি) ।

এতসত্তেও যারা নিজেদের আল্লাহর দরবারে গুনাহগারের থেকে মুক্ত করতে পারবেনা তারা নিতান্তই দুর্বাগা, অসহায়, হতবাগা। আল্লাহর রাসূল স: বলেন:

صعد النبي صلى الله عليه وسلم المنبر فقال آمين آمين آمين فلما نزل سئل عن ذلك فقال أتاني جبريل فقال رغم أنف امرئ أدرك رمضان فلم يغفر له قل آمين فقلت آمين ورغم أنف امرئ ذكرت عنده فلم يصل عليك قل آمين فقلت آمين ورغم أنف رجل أدرك والديه أو أحدهما فلم يغفر له قل آمين فقلت آمين

অর্থ: একদিন রাসূল স: মিম্বারের উপর উঠলেন অতপর বললেন, আমীন! আমীন! আমীন! যখন রাসূল স: মিম্বার থেকে নামলেন তাকে আমীন বলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো। তিনি বললেন,আমার নিকট জিব্রাঈল আ: আসলেন তার চেহারা ধুলায় মলিন হোক যে রমজান পেল অথচ তার গুনাহ ক্ষমা করে নিতে পারলোনা। বলুন আমীন! আমি আমীন বললাম। তারা চেহারা ধুলায় মলিন হোক যার নিকট আপনার উল্লেখ করার পর আপনার উপর দুরুদ পড়েনি। বলুন আমীন! আমি আমীন বললাম। ধুলায় মলিন হোক তার চেহারা যে তার পিতা-মাতা উভয়কে পেল অথবা যেকোন একজনকে ফেল কিন্তু সে নিজকে মাফ করিয়ে নিতে পারেনি। বলুন আমীন! আমি আমীন বললাম (সহীহুত তারগীব)।

অন্য হাদীসে রাসূল স: বলেন:

ورغم أنف رجل دخل عليه رمضان ثم انسلخ قبل أن يُغفر له،

অর্থ: ধূলায় মলিন হোক তার চেহারা যার নিকট রমজান আসল এবং তার ক্ষমা হওয়ার পূর্বেই তার থেকে রমজান বিদায় নিল। (তিরমিযি )

প্রিয় রোজাদার ভাই-বোনেরা আপনার সারা জীবনের গুনাহ মাফ করে নেওয়ার জন্য রমজান হলো অবিস্বরনীয় ‍সুযোগ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করার জন্য প্রস্তু শুধু প্রয়োজন নিজের গুনাহের স্বীকৃতি দেওয়া, গুনাহ না করার অঙ্গীকার করা এবং একনিষ্ঠভাবে তার নিকট তাওবা করা।

 

হাদীসদ্বয়ের শিক্ষা :

১. পূর্ণ একাগ্রতার সাথে সিয়াম পালন করা।

২. ফরজ সালাতের পাশা-পাশি সালাতুত তারাবী, কিয়ামুল্লাইল করা।

৩. কুরআন মাসে নিজকে কুরআনের আলোকে সজ্জিতত করা।

৪. সকল প্রকার অশ্লীলতা ও গুনাহের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

৫. নিজের গুনাহের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া।

 

লেখক, হাফেজ, মাও: নুরুল হুদা
কুরআনিক সায়েন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবির হাট, চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights