সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

যখন বান্দার ডাকে আল্লাহ সাড়া দেন

বান্দার ডাকে আল্লাহ সাড়া দেন

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আল্লাহর বাণী- ‘হে নবি! আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন বলে দাও, আমি তাদের অতি নিকটে। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেওয়া ও আমার ওপর ঈমান আনা তাদের একান্ত কর্তব্য। এ কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে’- সুরা বাকারা ১৮৬ আয়াত।

১৮৫ নং আয়াতটি রমজানের রোজা ফরজ সম্পর্কীয় এবং এর পরের ১৮৬ নং আয়াতটি নিয়েই আলোচনা। মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড়ো নেয়ামত হলো হেদায়াত এবং দুনিয়ায় পাঠানোর সময় ভীত-সন্ত্রস্ত হযরত আদম আ-কে আল্লাহ অভয়বাণী শুনিয়েছিলেন- ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই’। হযরত আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ ও প্রথম নবি। নবি প্রেরণের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবি হলেন মুহাম্মদ সা. এবং সর্বশেষ কিতাব হলো আল কুরআন। এই রমজান মাসে কুরআন নাজিল, কুরআনের পরিচিতি (মানুষের জন্য হেদায়াত, দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত ও সঠিক পথ প্রদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) এবং কুরআন মেনে চলার উপযোগী গুণ (তাকওয়া) সৃষ্টির লক্ষ্যে রোজার বিধান; সাথে হেদায়াত দানের জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ও শোকরগুজার বান্দা হওয়ার প্রসঙ্গ ১৮৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহর এসব নেয়ামত দানের পর বড়ো আবেগভরা ভাষায় তিনি বলেছেন, তাঁর বান্দার ডাকের অপেক্ষায় তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া বা গুম হয়ে যাওয়া সন্তান ফিরে আসার ব্যাপারে মা’র ব্যাকুলতা, কখন তার সন্তান ফিরে আসবে এবং যখনই ফিরে আসবে তখনই বুকে জড়িয়ে ধরবেন- এই মানসিকতা নিয়েই মা’র অপেক্ষা। আল্লাহই মা’র অন্তরে এই স্নেহ-ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। আল্লাহর অবস্থা এমন মা’র চেয়ে সহস্র গুণ বেশি।

আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা ও দরদ তুলনাহীন। তাঁকে ভুলে যাওয়া বান্দার ব্যাপারে আল্লাহর মনোভাব বড়ই ইতিবাচক, তাঁর বান্দার ফিরে আসার ব্যাপারে তাঁর অপেক্ষার যেন শেষ নেই। কখন বলে ওঠে- ‘পরোয়ারদেগার! আমি বড়ো ভুল করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো’। হ্যাঁ, এতটুক ডাক শোনার জন্য তাঁর এই অপেক্ষা। হাদিসের ভাষাও তাই বলে। মরুভূমিতে গাছের ছায়ায় বিশ্রামরত পথিকের মাল-সামানসহ উট হারিয়ে যাওয়ার পর নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে গাছের ছায়ায় বিশ্রামরত পথিক ঘুম থেকে জেগে মাল- সামানসহ উটকে ফিরে পেলে পথিকের আনন্দের কোনো শেষ থাকে না; আল্লাহর নাফরমান বান্দার তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তনের ফলে তাঁর অবস্থাও সেই পথিকের মতই হয়ে থাকে। তাইতো তাঁর নাফরমান বান্দাদের এতো জুলুম-নির্যাতন তিনি নীরবে সহ্য করেন এবং দেখেন ফিরে আসে কি-না। মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন বিশেষ করে তাঁর প্রতি ঈমান আনার কারণে ঈমানদারদের প্রতি জুলুম, এটা আল্লাহ তায়ালার কাছে বড়ো অসহনীয় ও কষ্টদায়ক। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন- ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তওবা করে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’। ‘অতঃপর তওবা করে না’ বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই কথার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নাফরমান বান্দাদের ফিরে আসার পথ তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন।

১৮৬ নং আয়াতে আল্লাহর সম্বোধন ‘আমার বান্দা’ বড়ো আদরের ডাক ও তাঁর সকল বান্দাকেই (কাফির-মুসলিম নির্বিশেষে) এই ডাকের মধ্যে শামিল করে নেয়া হয়েছে। আল্লাহকে ডাকার জন্য সময়-ক্ষণ (ইফতারের মুহূর্ত, আছরের সময়, শেষ রাতে) ও স্থান (মসজিদ, মসজিদে নববি, মসজিদে হারাম) গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর কাছে ফিরে আসার ক্ষেত্রে এ সবের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। তাঁর কাছে ফিরে আসা বা তাঁকে পাওয়ার জন্য আজমীর শরীফ, শাহজালালের দরগাহ, বড়পীর সাহেবের দরগাহ কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই (জিয়ারত উদ্দেশ্যে তিনটি মসজিদ- মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদে আকসা ছাড়া আর কোথাও সফরের বৈধতাও নেই); আবার কোনো পীর-পুরোহীত-পাদ্রী- মৌলভী- মুন্সি ধরারও প্রয়োজন নেই বা বিশেষ কোনো ভাষা জানারও দরকার নেই বা উচ্চস্বরে ডাকারও প্রয়োজন নেই। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী এবং সকল শ্রেণি-পেশা-বয়স-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে তিনি সবারই স্রষ্টা ও মনিব এবং সবাই তাঁরই বান্দা। তিনি চান সবাই তাঁর দেয়া হেদায়াত অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে সুখি জীবন- যাপন করুক। এ জন্যই তো তাঁর এত আয়োজন – নবি ও কিতাব প্রেরণ। এই দুনিয়ার জীবনে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকল বান্দার জন্য তিনি অত্যন্ত দয়ার্দ্য ও ক্ষমাশীল; কিন্তু আখিরাতে হবেন মু’মিনদের প্রতি অত্যন্ত উদার এবং কাফিরদের প্রতি হবেন অত্যন্ত কঠোর।

শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। সে সবসময় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায় এবং তাকে অন্যায় কাজে প্ররোচনা দেয়। পাপের পথটাকে সে বড়ো লোভনীয় করে তুলে ধরে এবং আল্লাহ ও আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়। আল্লাহর ক্ষমা ও উদারতাকে সে তার থেকে আড়াল করে রাখে এবং অপরাধে ডুবে থাকার কারণে এক পর্যায়ে মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়ে। সে ভাবে জীবনে ৫০/৬০টা বছর অতিক্রম করে আসলাম, কতো অপরাধ করলাম- সুদ, ঘুষ, জেনা-ব্যাভিচার, গুম-খুন কোনো কিছুই তো বাদ যায়নি, আবার জীবনের দীর্ঘ সময় এক ওয়াক্ত নামাজও আদায় করা হয়নি ও একটি দিন রোজাও রাখা হয়নি; শুনেছি এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা যাওয়ার জন্য ৮০ হোব্বা দোজখ ও প্রতি হোব্বা দুই কোটি অষ্টাশি লক্ষ বছর দোজখে থাকতে হবে; এমতাবস্থায় জীবনের অংক কষতে গিয়ে সে খেই হারিয়ে ফেলে এবং তখন সে বাকি জীবনটা এভাবেই কাটাতে চায়।

আবার যারা তরুণ, শয়তান তাদের প্ররোচনা দেয়, জীবনকে উপভোগ করার এটাই তো সময়, বুড়ো হলে ধর্মকর্ম করো। এ সবই শয়তানের ধোকা। শয়তানের সকল চক্রান্তজাল ছিন্ন করে সত্যের পথে ফিরে আসার আল্লাহর এ এক উদাত্ত আহবান। আমার বান্দা বলে অত্যন্ত দরদের সাথে আল্লাহ বলেছেন, তিনি তাঁর বান্দার অতি নিকটে এবং যখনই তাঁকে ডাকা হয় তখনই তিনি শুনতে পান ও সাড়া দেন। শুধু আল্লাহর পথে ফিরে আসা নয়, বান্দার সকল প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহরই কাছে চাইতে হবে এবং তিনি দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। এর বিনিময়ে আল্লাহর চাওয়া হলো তাঁর বান্দারা তাঁর আহবানে সাড়া দেবে অর্থাৎ তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাঁর দেওয়া হেদায়াত অনুসরণ করবে। আল্লাহর এই অপার ক্ষমা ও বান্দার প্রতি দরদ সবাইকে শুনিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর নবিকে বলেছেন, যাতে তাঁর বান্দারা ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত যেসব ইবাদত-বন্দেগি এতদিন করে আসেনি, তওবার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা পাওযা যাবে; কিন্তু মানুষের সাথে সম্পর্কিত অপরাধ কীভাবে ক্ষমা হবে? হ্যাঁ, নিষ্ঠার সাথে তওবা করে ফিরে আসলে এবং পুনরায় অপরাধ কর্মে জড়িয়ে না পড়লে তার একটি বিধানও আল্লাহপাক তার অন্তরে জাগিয়ে দেবেন। আসলে তওবা এমন একটি বিষয় যা মানুষকে পূর্বে কৃত অপরাধ থেকে মুক্তি দান করে। অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জিত হওয়া, বারবার কাতরকন্ঠে আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহপাক তাকে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন।

সংশ্লিষ্ট আল্লাহর বান্দাদের পাওনা পরিশোধ বা ক্ষমা চেয়ে নেয়ার মাধ্যমে সম্ভব না হলে আল্লাহ নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেই বান্দার বিনিময় প্রদান করবেন। এজন্য সর্বাগ্যে প্রয়োজন আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন (তওবা করা)। কাফির-মুশরিকরা তো রয়েছেই, মুসলমানদেরও একটি অংশ আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত। এই পবিত্র রমজান মাস গুনাহ মাফ করে নেওয়ার একটি অপূর্ব সুযোগ। তাই শয়তানের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত উপেক্ষা করে আমাদের সবারই উচিত মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর হেদায়াত মেনে নেয়া।

আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর পথে ফিরে আসার তৌফিক দান করুন। আমিন।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights