
রমজানের ফজিলত ও শিক্ষা
ডক্টর বি এম শহীদুল ইসলাম
রমজানের ফজিলত ও শিক্ষা বর্ণনা করে শেষ করা অত্যন্ত কঠিন। রোজা এমন একটি ইবাদত যা সরাসরি দেখা যায় না। কোনো ব্যক্তি হজ পালন করলে সেটা দৃশ্যমান হয়। নামাজ আদায় করলে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু কেউ রোজা পালন করলে সরাসরি দেখা যায় না- যদি ওই ব্যক্তি না বলেন যে, আমি রোজাদার। পবিত্র কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। বদরের যুদ্ধ রমজান মাসেই সঙ্ঘটিত হয়েছিল। তাই রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে- যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। নিচে রমজানের ফজিলত ও শিক্ষা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
রোজার অর্থ : রোজা ফারসি শব্দ। এর অর্থ বিরত থাকা। আরবি ভাষায় রোজাকে সাওম বলা হয়। সাওম-এর শাব্দিক অর্থ- বিরত থাকা, উপবাস থাকা, অনশনে থাকা, আত্মসংযম পালন করা ইত্যাদি।
রোজার সংজ্ঞা : ইসলামী পরিভাষায় মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো প্রকার পানাহার ও দৈহিক যৌন তৃপ্তি থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলে।
রোজা একটি মৌলিক ইবাদত : ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সাওম অন্যতম। মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে ঈমান ও সালাতের পরেই সাওম বা রোজার স্থান। অর্থাৎ সাওম ইসলামের রোকনগুলোর মধ্যে তৃতীয় রোকন। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নর-নারী হোক ধনী-দরিদ্র, ফকির, মিসকিন সব মুসলমানের ওপর সাওম একটি ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ইবাদত।
রমজানের রোজা ফরজ : ঈমানদার ব্যক্তিদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার ( সূরা বাকারাহ: ১৮৩)।
সাওমের শিক্ষা : সাওম পালনের মাধ্যমে রোজাদারের আত্মিক উন্নতি ও মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। অন্তরে তাকওয়া জাগ্রত হয় ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সওম পালনকারী ‘রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবে। হজরত সাহাল ইবনে সায়াদ রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন : বেহেশতের আটটি দরজা আছে। তার মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। উক্ত বিশেষ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদার ব্যক্তিরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে (সহিহ আল বুখারি ও মুসলিম)।
সহনশীলতা অর্জন : সহনশীল মানুষকে আল্লাহ তায়ালা খুব পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন। সাওম পালনের মাধ্যমে ঈমানদার ব্যক্তি মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য অর্জনের চেষ্টা করেন। তাই তিনি বিপদে-আপদে ও মুসিবতের সময় বেশি বেশি ধৈর্য ও সহনশীল মনোভাবের অভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
আত্মশুদ্ধি অর্জন : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার নিজের মাঝে আত্মসমালোচনার অভ্যাস গড়ে তোলেন। কাজেই নিজেই নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ফলে তিনি আত্মশুদ্ধি অর্জনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে করিম সা: ঘোষণা করেছেন; যে লোক ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রমযানের রোজা পালন করবে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ)।
হিংসাবিদ্বেষ বর্জন : মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও কামভাবের বশবর্তী হয়ে অনেক অপকর্মে লিপ্ত হয়। সাওম মানুষকে এসব খারাপ কাজ থেকে মুক্ত থাকতে শিক্ষা দেয়। সাওম মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে বাঁচারও শিক্ষা দিয়ে থাকে।
রোজা ঢালস্বরূপ : ঢাল হচ্ছে- আত্মরক্ষার বাহন। ঢাল যেমন মানুষকে বিপদের মুহূর্তে আত্মরক্ষা করে, তেমনি রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। নবী করিম সা: বলেছেন, আসসিয়ামু জুন্নাতুন। অর্থাৎ ‘রোজা ঢালস্বরূপ’ (বুখারি ও মুসলিম)।
দরিদ্রের প্রতি দানশীলতা : রোজা মানুষকে দানশীল হতে শিক্ষা দেয়। রমজান মাসে রাসূল সা: দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের দান-সদকা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেও দান-সদকা করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: লোকদের মধ্যে অধিক দানশীল ছিলেন। বিশেষ করে রমজান মাস এলে তাঁর দানশীলতা অনেক বেড়ে যেত (বুখারি ও মুসলিম)। সুতরাং সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমরা পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারি যে, সাওম অসহায় ও দরিদ্রকে দান করতে উদ্বুদ্ধ করে।
সাওমের প্রতিদান : সব সৎ কাজের প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা দশগুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেবেন। কিন্তু রোজার প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে বান্দাকে দেবেন। সাওমের প্রতিদান সম্পর্কে হদীসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আসসিয়ামুলি ওয়া আনা উয্যিবিহি অর্থাৎ ‘সাওম আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব (সহিহ আল বুখারি)।
অশ্লীলতা পরিহার : আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত অশ্লীলতা ও অসামাজিক কার্যকলাপের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। সাওম পালনকারী ব্যক্তি এসব অন্যায় ও অশ্লীলতা পরিহার করে চলে। হানাহানি থেকে দূরে থাকে। অন্যের ক্ষতি সাধন করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। চোগলখোরি গীবত ও পরনিন্দা থেকে দূরে থাকে। পরশ্রীকাতর মনোভাব পরিত্যাগ করে। ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তি বিরাজ করে।
মিথ্যা পরিত্যাগ : মিথ্যা হচ্ছে- সব পাপ কর্মের মূল। একজন রোজাদার ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। ফলে সে নিজেকে একজন সত্যবাদী মুমিন হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পায় এবং মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবী করিম সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তার খানাপিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই (সহিহ আল বুখারি)।
পরিশেষে বলা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিলের প্রত্যাশায় এবং তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষের নিষ্ঠার সাথে সাওম পালন করা অবশ্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রমজানের রোজা পালনের তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : গবেষক
তথ্য সূত্র : নয়াদিগান্ত
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.