সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

মনন সংস্কারে মহানবি সা. এর সুক্ষ্মদর্শিতা

সিরাত প্রবন্ধ

মনন সংস্কারে মহানবি সা. এর সুক্ষ্মদর্শিতা

আল্লাহ পৃথিবীর মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে, অন্যায়-বিচ্যুতি হতে হেফাজত করতে, অপকর্ম-খোদাদ্রোহীতা হতে মুক্ত রাখতে, যুগে-যুগে প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজনমাফিক হেদায়াতকারী, সতর্ককারী প্রেরণ করেছেন।

আল্লাহ বলেন-

وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ

কোনো জাতিকে সতর্ককারী প্রেরণ ব্যতিত রাখেন না  [সূরা ফাতির : ২৪]। প্রত্যেক নবিই তার আপন অঞ্চলের, নির্ধারিত জাতির বা ভাষা-ভাষী লোকজনের মধ্যে একান্ত আন্তরিকতার সাথে এ শুদ্ধিকর্ম পরিচালনা করেন। এ শুদ্ধিকর্ম পরিচালনা করতে গিয়ে নানামাত্রিক বিপত্তি, বহুরৈখিক প্রতিবন্ধকতা, সমূহ বিপদগ্রস্ততার মুখোমুখি তারা হয়েছেন। সামাজিক হেনস্তা, পরিবারিক বাধা, রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা, সম্মিলিত প্রতিরোধ কখনওবা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মুকাবিলা তাদেরকে করতে হয়েছে। সময়, শ্রম তো গেছেই, তার সাথে বকুনি-কটুকথা হজম, অত্যাচার-নিগ্রহণ সহ্য করতে হয়েছে। শুধু তাই নয় প্রয়োজনে রক্ত দিতে হয়েছে। শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিসর্জন দিতে হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো রাসুলকে জীবনও দিতে হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে এর উদাহরণ বিরল নয়।

এই শুদ্ধি অভিযানের জন্য যারাই আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও নির্বাচিত তারাই আমাদের কাছে নবি ও রাসুল হিসেবে পরিচিত। যুগে যুগে তারাই অন্ধকার পৃথিবীতে জালিয়েছেন আলোর মশাল। অশান্ত পৃথিবীতে ছড়িয়েছেন শান্তির বার্তা। যাবতীয় অশ্লীলতাকে ধুয়ে মুছে মাফ করে দিয়েছেন শ্লীল সংস্কৃতির অমিয় বাতাবরণ।

সংস্কারের এই মহান দায়িত্ব সকল নবির জন্যই আবশ্যক ছিল। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপরও এই একই দায়িত্ব ছিল। উল্লেখ্য যে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রকাশ্য সংস্কার কখনই ফলপ্রসু হবে না যদি তার ভিতরকে কলুষমুক্ত না করা যায়। তাই সংস্কারকে শতভাগ সফল করতে হলে ঐ জাতি বা সমাজের মন, মনন, মানস ও অন্তরের সংস্কার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। নতুবা ঐ সংস্কার অপূর্ণাঙ্গ হতে বাধ্য। বরং তা ব্যর্থ হতেও বাধ্য।

মহান আল্লাহ আল-কুরান আল কারিমের সুরা আল বাকারায় বলেন-

فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا

তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি। আর আল্লাহ তা বাড়িয়ে দেন। [সূরা বাকারা : ১০]

এ আয়াতটি মদিনায় আহলি কিতাব ও মুনাফিকদের সামনে অবতীর্ণ হলেও এটিই ছিল রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৌলিক কাজ। তার যে বহুমুখি সংস্কার রয়েছে তন্মধ্যে তার মানস সংস্কারই ছিল মৌলিক সংস্কার। তার নবুওতি জীবনের প্রথম তেরো বৎসরের মাক্কি জীবনের সর্বাংশ জুড়ে ছিল মানস সংস্কার কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। কারণ এটিই সত্য যে, কোনো আন্দোলন, বিপ্লব কিংবা সংস্কারই ফলপ্রসু হতে পারে না তার অভ্যন্তরের সংস্কার ব্যতিত। তাই পরম যত্নের সাথে, অতি আগ্রহের সাথে তিনি মানস সংস্কারের মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন সারা জীবনব্যাপী। মননের চাষ মানবের জন্য এক অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। বিশ্ব ইতিহাসের পাঠ থেকে সুনিশ্চিত হওয়া যায়- মহামানব এবং বিশ্ব ব্যক্তিত্বরা কোনো না কোনোভাবে আবশ্যিকরূপে তারা মানস ও মগজের চাষ করতে প্রয়াসি হয়েছেন। তাই আমরা এ প্রবন্ধে রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মানস সংস্কারের কতিপয় দিক ও তার প্রকৃতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত ও বোধগম্য আলোকপাতের প্রয়াস পাব।

রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদ্যপি নবি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন সেদিন হতেই মক্কাবাসীর উন্নয়ন ও শুদ্ধির জন্য মনন ও মানসের চাষ শুরু করেছেন অতিব যত্নের সাথে। কারণ জাতির টেকসই উন্নয়নের জন্য এটি পূর্বশর্ত। তিনি নবুওতি জীবনের প্রথমাংশ তথা মাক্কিজীবনের প্রতিটি পরতকে গ্রথিত করেছেন মানস চাষের নিয়মতান্ত্রিকতায়। তার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল মক্কা হতে মদিনা হিজরতের পরেও। হিজরত পরবর্তি জীবনে তার রাষ্ট্রিক ব্যস্ততা, যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা, আরবের বাইরের বিশ্বে ইসলামের সুমহান আহবান পৌছানোর মহান প্রয়াস, নবদীক্ষিত মুসলিমদের ইসলামের সঠিক দীক্ষা প্রদান, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো মজবুতকরণের সঠিক নির্দেশনা ইত্যাকার সকল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুমিনদের মননের চাষ ও তাকে উৎকর্ষ মাত্রায় পৌঁছানোর সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা লক্ষনীয়। কারণ রাষ্ট্রের বা সমাজের কিংবা পরিবারের কোনো ভিত্তিই টেকসই হবে না যদি না সেই কর্মোদ্যোগের পথে মনন ও মানসের যথা সংযোগ থাকে। এই উপলব্ধির বাস্তবতা থেকেই মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মননের সংস্কারের প্রতি গভীর মনোযোগ প্রদান করেন। কী ব্যক্তি, কী সমাজ, কী অতিথি, কী বিদেশী সবার সাথেই তার ব্যক্তি আচরণ কিংবা সামাজিক আচরণের নেপথ্যের উদ্দেশ্য ছিল তার মননের উৎকর্ষ বিধান ও সমাজ কাঠামোর ভিত্তিকে দৃঢ় করতে তা কাজে লাগানো। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক মননের উৎকর্ষতায় তার বাস্তবানুগ নানান পদক্ষেপ, পরিকল্পনা ও কর্মসুচির প্রতি আমরা দৃকপাত করতে প্রয়াস পাব।

একজন মানুষের মনন ও মানসকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত করে তার নিত্য দৈনিকতা, তার নিত্য আচরণের এসব বিষয়ে লক্ষ করলেই উপলব্ধি করা যায় তিনি কেমন মানসিকতার? তার প্রকৃতি কোন ধরণের? তার ব্যক্তিত্ব ও পর্যবেক্ষণ প্রকৃতি কেমন? আধুনিক মনোবিজ্ঞান মনে করে মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, স্বভাব, প্রকৃতি ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত, পরিমিত ও পরিশীলিত করে প্রধানত তার নিত্য চারটি অভ্যস্ততা। সেগুলি হলো-

ক. খাদ্যাভ্যাস বা Eating pattern                 খ. নিদ্রাভ্যাস বা Sleeping pattern

গ. আচরণাভ্যাস বা Behaviouring pattern    ঘ. চিন্তাভ্যাস বা Thinking pattern

এই চারটি অভ্যাস বা প্যাটার্নই মূলত একজন মানুষের মনন, মানস এমনকি মস্তিস্কের উপরও নিরবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সত্যি বলতে মনন ও মানসের পরিগঠনে উপর্যুক্ত অভ্যাসগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য ও অনিবার্য। প্রশ্ন হতে পারে নিত্য খাবার, নিত্য নিদ্রা কিংবা নিত্য আচরণ কিভাবে একজন ব্যক্তির মানস পরিগঠনে ভূমিকা রাখতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে ঈষৎ চিন্তাই আমাদেরকে বলে দেয় হ্যাঁ, তা পারে বৈকি। কারণ যে খাদ্য শরীর ও দেহকে পরিগঠনে কিংবা দেহ বৈকল্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে, যেই খাবার দেহকে ঝরঝরে রাখতে সাহায্য করে সেই খাবার কি আমার মনকে ফুরফুরে করে রাখতে পারে না, মননকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখতে পারে না? অবশ্যই পারে।

যে নিদ্রা-স্বল্পতা আমার চোখ-মুখ ফুলিয়ে রাখে, চেহারার সর্বত্র অবসন্নতা ছড়িয়ে দেয়, এমনকি অল্পনিদ্রা অনিদ্রার অসুখে পরিণত হয় সেই নিদ্রা কি আমার সুখের কারণ হতে পারে না? বিশেষায়িত নিদ্রা কি অধিকাংশ অসুখের দাওয়াই হিসেবে কাজ করে না? অবশ্যই করে। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- নিদ্রা যদি হয় নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত, পরিমিত তবে তা মনন গঠনের সহায়ক হতে বাধ্য।

আচরণের ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরণের পর্যবেক্ষণ পেয়ে থাকি। দেখা থেকে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে, সমৃদ্ধ পড়াশুনা থেকে, মহানজনদের জীবন থেকে শেখা পরিশীলিত আচরণ অবশ্যই ব্যক্তিকে সুমার্জিত, সুসৌজন্য করতে সক্ষম। আবার সাহচর্য কিংবা সঙ্গ থেকে, চারপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ থেকে, পরিবেশের সংক্ষুব্ধতা থেকে, পারিবারিক বেষ্টনীর সীমাবদ্ধতা কিংবা অপূর্ণতা থেকে বেরুতে না পারলে অবশ্যই তা ব্যক্তিকে অপরিশীলিত, অপূর্ণাঙ্গ কিংবা অযাচিত ব্যক্তিতে পরিণত করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর চিন্তাভ্যাসের বিষয়টি আমরা কিয়দ বিলম্বে কিঞ্চিত বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব। কারণ আমাদের আজকের আলোচনার গন্তব্যবিন্দু সেটিই।

মহানবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সামাজিক তৎপরতা, হাঁটা-শোয়া, চলা-ফেরা, চলন-বলন, কথা-কাজ, শয়ন-জাগরণ, বক্তৃতা-বিবৃতি, আচার-আচরণ, কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব, ওয়াজ-নসিহত, আদেশ-নিষেধ, সম্মতি-অনুমোদন, যুদ্ধ-সন্ধি, চিন্তা-চেতনা, ভালোবাসা-ঘৃণা, স্বপ্ন-বাস্তবতা জীবনের প্রতিটি ক্ষণে যাবতীয় কর্ম তৎপরতায় মনন পরিগঠন প্রক্রিয়ায় পরিব্যপ্ত ছিলেন। যেন তার একমাত্র কাজই ছিল এটি। এটিই ছিল তার মৌলিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আল-কুরান আল-কারিমে তাকে যে কাজের জন্য প্রেরণ হয়েছে মর্মে যে ঘোষণা বারবার দেওয়া হয়েছে তারও নেপথ্যে এই কাজেরই স্বীকৃতি ও প্রেষণা। মনন পরিগঠন কর্ম সেই মহান কাজকে আরো দ্রুততর, আরো তরান্বিত করতে সহায়তা করেছে সর্বতোভাবে। মানবের চিরায়ত এ অভ্যাসগুলোকে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা ইসলাম কিভাবে পরিশীলিত করতে চেয়েছেন আমরা তা জানতে এবার প্রবৃত্ত হব।

রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাদ্যাভ্যাস এবং এ সংক্রান্ত তার বিবৃতি ও নির্দেশনা সত্যিই অবাক করার মতো। যার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ ও অধ্যয়ন বলতে কিছুই ছিল না। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান তো অনেক দূরের বিষয়। আর তদানীন্তনকালে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের কোনো উৎকর্ষতাও ছিল না। আজকের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান তাই তার খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য নির্দেশনায় বিস্মিত না হয়ে পারে না।

রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাদ্যাভাস ছিল সর্বদার জন্য অনুকরণীয়, অনুসরনীয়। তিনি অরুচি ও কুরুচিপূর্ণ খাবার হতে বিরত থাকতেন। তিনি ঐ সকল প্রাণী বা প্রাণীর মাংস খেতেন না, যারা ময়লা-বর্জ নিয়মিত ভক্ষণ করে। এর নেপথ্যের কারণ সম্ভবত এমন হয়ে থাকবে অরুচি ও কুরুচিপূর্ণ খাবার স্বভাবত মানব মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে যা হজম প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিকে উদারপীড়ায় নিপীড়িত করে তুলবে। আর উদরপীড়া ব্যক্তির মনন ও মানসকে শীঘ্র অসুস্থ ও বিষন্ন করবে।

একইভাবে তিনি বেশি খেতে বারণ করেছেন। কারণ তিনি অতি সেবন মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আমাদেরকে সে সবক দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।

তিনি হাদিসে বিবৃতি দিয়েছেন-

المؤمن يأكل بمعى واحد والكافر بسبعة أمعاء

মুমিন খায় এক পেটে আর কাফির খায় সাত পেটে। [সহীহ বুখারী : ৫০০১] অর্থাৎ কাফিরের খাওয়ার পরিমাণ অনির্ধারিত, অপরিমেয়। আর মুমিনের খাবার অবশ্যই স্বল্প ও পরিমিত। পরিমিত আহারের ব্যাপারে তিনি উৎসাহিত করে বলেন

طَعَامُ الْوَاحِدِ يَكْفِي الاِثْنَيْنِ وَطَعَامُ الاِثْنَيْنِ يَكْفِي الأَرْبَعَةَ ‏

একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট। আর দুজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। [ সহীহ মুসলিম, ইফা: ৫১৯৭] খাবারে পরিমিতিবোধের ব্যাপারে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বিবৃতি আর কী হতে পারে? এ শুধু বিবৃতি নয় এর প্রকৃষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত নবি জীবনের পরতে পরতে পাওয়া যাবে।

তার খাদ্যাভ্যাসে পাওয়া যায়- তিনি খেজুর, লাউ, মধু, সির্কা, যব, গোস্ত ইত্যাদি পছন্দ করতেন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গবেষণায় খেজুর ও লাউ এর বহুবিধ উপকারের সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত। খেজুর এবং লাউ আজ বিজ্ঞানের আদর্শ খাদ্য তালিকাভুক্ত। আলহামদুলিল্লাহ।

হাদিসে এসেছে-

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم كلوا الزيت وادهنوا به

তোমরা জায়তুনের তেল খাও এবং তা মালিশ করো। (তিরমিজি, ইফা : ১৮৫৮)

قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ فَذَهَبْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى ذَلِكَ الطَّعَامِ، فَقَرَّبَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خُبْزًا وَمَرَقًا فِيهِ دُبَّاءٌ وَقَدِيدٌ، فَرَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَتَتَبَّعُ الدُّبَّاءَ مِنْ حَوَالَىِ الْقَصْعَةِ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে রুটি এবং সুরুয়া যাতে কদু ও গোশতের টুকরা ছিল, পেশ করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখতে পেলাম যে, পেয়ালার পার্শ্ব থেকে তিনি কদুর টুকরা খোঁজ করে নিচ্ছেন। [সহীহ বুখারী, ইফা : ১৯৬২]

অন্য হাদিসে এসেছে-

عن عائشة قالت كان النبي صلى الله عليه وسلم يحب الحلواء والعسل

আয়েশা রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিষ্টি ও মধু পছন্দ করতেন। [সহীহ বুখারী, ইফা: ৫০৩৭]

আরেক হাদিসে এসেছে-

وَعَنْ يُوسُفَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَلَامٍ قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذَ كِسْرَةً مِنْ خُبْزِ الشَّعِيرِ فَوَضَعَ عَلَيْهَا تَمْرَةً فَقَالَ: «هَذِهِ إِدَامُ هَذِهِ

ইউসুফ ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেছি, তিনি এক টুকরা যবের রুটি নিয়ে তার উপরে খেজুর রেখে বললেনঃ এটা (খেজুর) এর (রুটির) তরকারী এবং তা খেলেন। [যয়ীফ, মিশকাতুল মাসাবীহ : ৪২২৩]

একইভাবে খাবারে স্থিরতা অবলম্বন করা, সৌজন্য রক্ষা করা, পানি পানের শিষ্টতা, খাবার নষ্ট না করা, প্লেট চেটে বা মুছে খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে রাসুলের যেসব নির্দেশনা সত্যিই তা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য উপাদেয়। রাসুলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে ততই তা বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক প্রমাণিত হচ্ছে। একজন মানুষের দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারে তার নির্দেশনা সুস্থ দেহ ও মন পরিগঠনে সত্যিই অনবদ্য। তিনি বলেছেন- তোমরা খাবার গ্রহণের সময়ে পেটকে তিনভাগ করো। এক অংশে খাবার, আরেক অংশে পানীয় অবশিষ্টাংশে বাতাস দ্বারা পূর্ণ করো। অর্থাৎ তা খালি রাখো। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও খাবারের এ নির্দেশনা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রমাণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে খেতেন, যেভাবে খেতে বসতেন, যেভাবে চিবাতেন, পানীয় সেবনে যেভাবে শ্বাস নিতেন, যেরূপ সময় নিয়ে খেতেন, যে পরিমাণ খেতেন, দুই খাবারের মাঝখানে যতটুকু বিরতি দিতেন সবই আজকের আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এক একটি অলৌকিক উপাদান ও মানব জীবনের অনস্বীকার্য আদর্শ হিসেবে পরিগণিত।

আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজে দেখেছি মানুষের অসুস্থতার হার। ঐ সমাজে মানুষ বিশেষত মুমিন সমাজের সভ্যবৃন্দ তেমন কোনো অসুখে ভুগতেন না। সাহাবীরা অসুস্থতা কী জিনিস তা যেন ভুলেই গিয়েছিল। এর মূল কারণও ছিল তাদের খাদ্যাভ্যাস।

একটি গল্পের অবতারণা করেই আমরা এ আলোচনা থেকে অন্যদিকে যাব। গল্পটি হলো- একবার পারস্য সম্রাট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে একজন চিকিৎসক উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। চিকিৎসক মদিনা পৌঁছালে তাকে বসার ব্যবস্থা করা হয়। রোগির আশায় সে সারাদিন বসে থাকে। কিন্তু রোগি বলতে তেমন কিছুই পায় না। এইভাবে একমাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়। চিকিৎসক ভাবে- মদিনা আমার জন্য নয়। সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকাশে হাজির হয়ে আবেদন করে। জনাব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি আমাকে মুক্তি দিন। এখানে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ গত এক মাসে একজন রোগিও আমার কাছে আসেনি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিদায় জানানোর প্রাক্কালে চিকিৎসক জানতে চান- আমার কাছে কোনো রোগি না আসবার হেতু কী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বাক্যে তাকে জানান- আমি এবং আমার অনুসারীরা ক্ষুধা না পেলে খাই না। আর খাইতে বসলে কখনই পেট ভর্তি করে খাই না। প্রশ্নের এমন উত্তরে বিদেশি চিকিৎসক অভিভূত হয়ে যান। সত্যিই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী এবং দর্শন ছিল অবিস্মরণীয় ও আশ্চর্যকর। উদর পূর্তি করে, পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে, স্বাদ আস্বাদনে মত্ত হয়ে খাদ্য সেবন একজন মানুষের জন্য কত বড় অশনি ডেকে আনতে পারে আজকের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান তা উপলব্ধি করে- খাদ্যাভ্যাসের নানাবিধ বিধি-নিষেধ আরোপ করে থাকে।

এভাবেই মানব দরদি প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মানুষের শারিরীক সুস্থতা, দৈহিক উৎকর্ষ পরিগঠনের মাধ্যমে মনন ও মানসকে স্বতস্ফুর্ত ও সজীব রাখতে প্রয়াসি থেকেছেন। যা সতত মননের চাষে কার্যকরি ভূমিকা রেখেছে এবং একজন মানুষকে আল্লাহর অনুবর্তি হতে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। কারণ মনের অনাবিলতার পূর্বশর্ত দৈহিক সুস্থ্যতা ও অস্বস্তি হতে দূরে থাকা।

ঘুম বা নিদ্রা জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ

নিদ্রা ব্যতিত মানব দেহ সম্পূর্ণ নিরোগ ও সুস্থ হতে পারে না। তাই এই ঘুমেরও থাকা চাই নির্দিষ্ট ব্যকরণ। নতুবা তা ভুলপথে পরিচালিত হবে। যা হবে মানব দেহের সমূহ ক্ষতির সুতিকাগার। এই ক্ষতি হতে বাঁচতে হলে অবশ্যই বিশেষ নিয়মের অনুবর্তি হতে হবে। মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য এটিই যে, আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারেও দিয়েছেন সঠিক নির্দেশনা। যেমন-

ক. ফজরের পর দ্বিতীয়বার না ঘুমাতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ তা স্বাস্থ্য সংহারক। বরং ফরজ সালাতের পর কর্মোদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনা ইসলামের।

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ

আর যখনই তোমাদের সালাত সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো। আর রিজিকের তালাশ করো। ৬২: ১০;

খ. দুপুরের খাবার পর কিঞ্চিত বিশ্রাম। কেননা তাতে শরীরে ফিরে আসবে স্বতস্ফুর্ততা।

গ. রাতে খাবারের পর অল্প হাঁটাহাঁটি করো। কেননা তাতে রাতের ঘুমে আরাম হবে। নিদ্রা গভীরতর হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই নির্দেশনা দেখেই জনৈক ইংরেজ মন্তব্য করেন-

After launch rest a while. After dibber walk a mile.

আমরা বাঙলায় বলি-

মধ্যাহ্নভোজের পর হাল্কা বিশ্রাম, নৈশভোজের পর হাঁটাহাঁটি

সুস্থ শরীর, সতেজ মন, ঘুম হবে একদম খাঁটি।

ঘ. সার্বিক ঘুমের ব্যাপারে তার নির্দেশনা সকাল সকাল ঘুমিয়ে যাওয়া। প্রতিটি মুমিনের জন্য প্রয়োজনীয় এ ঘুমকে নিশ্চিত করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন- তোমরা ইশার সালাতের পর কেউ অপ্রয়োজনীয় গল্প গুজবে মত্ত হবে না। এ সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদিসের বর্ণনা আমাদের সামনে রয়েছে। সকাল-সকাল ঘুমানো একদিকে স্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে বিষন্নতা নিবারক। এই ঘুম একদিকে প্রশান্তিদায়ক। অন্যদিকে একাধিক অসুস্থতা থেকে মুক্তিদায়ক।

হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি তিনি অযথা নিশি জাগরণ করতেন না। বরং তিনি রাত্রির প্রথমভাগেই ঘুমিয়ে যেতেন। আর মধ্যভাগ বা তার পরপরই জেগে যেতেন। তিনি অন্তত এক প্রহর ভালোভাবে নিদ্রা যাপন করতেন। ফলে তিনি সর্বদাই সুস্বাস্থ্য, নিরোগ, স্বতস্ফুর্ত জীবন যাপন করতেন। তার নিদ্রাচার থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই হয়তো জ্ঞানীজনরা মন্তব্য করেছেন-

Early to bed & early to rise
Makes a man healthy, wealthy & wise.

আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলে- দিবারাত্রির যে সকল প্রহর রয়েছে তার মধ্যে একটি প্রহর মানবদেহ ও মানব মস্তিস্কের জন্য খুবই উপাদেয়। মানুষ যখন ঘুমায় তখন তার মস্তিস্কে এক ধরণের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গের মাঝে উঠা-নামা, কম-বেশির বিষয় রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এ সবের নানান নাম রয়েছে। তবে সব থেকে ব্যালেন্স ও সামঞ্জস্যপূর্ণ তরঙ্গ যেই প্রহরে কাজ করে সে প্রহরের তরঙ্গকে বলা হয় Delta Wave আর ঐ ঘুমকে বলা হয় Delta sleep। এই ঘুম শরীর, স্বাস্থ্য, দেহ, মন এবং স্মরণশক্তির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশের তারতম্য, প্রতিবেশের ব্যবধান, আবহাওয়ার রকমফের প্রভৃতি বিবেচনায় এর সময় ও মাত্রায় কম-বেশি হতে পারে। তবে সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এই সময়টি রাত দশটা থেকে রাত দু’টোর মধ্যে পাওয়া যাবে বলে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। অতএব রাত্রির এই অংশের ঘুম আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘুমের আবশ্যকতা আমরা তখন উপলব্ধি করি যখন দেখি- একজন ছাত্র সারা রাত পড়াশুনা করে অথচ সকালবেলায় কিছুই মনে করতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞান ঐ নির্দিষ্ট প্রহরের নিদ্রা না হওয়াকে চিহ্নিত করেছে। পূর্ণ রাত্রির নিরবচ্ছিন্ন জাগরণ পূণঃস্মরণকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই অধুনা বিশ্বের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিদ্রাভ্যাসের পরিপালন আমাদের ও আগামি প্রজন্মের মননের চাষ ও মানসের উৎকর্ষে সর্বাধিক নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এমন সুচারু, সুসামঞ্জস্য ও সমন্বিত নিদ্রা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জাতির উন্নত মনন গঠনের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছিলেন।

নিত্যাভ্যাস প্রসঙ্গে এ মন্তব্য অনায়াসে করা যায়- মানবতার মহান বন্ধু রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৈনিকতা ও নৈমিত্তিকতা একজন মানুষের সুস্থ মনন পরিগঠন সহায়ক। তার হাঁটার ধরণ, কথা বলার স্টাইল, সৌজন্যতা, আতিথেয়তা, পোশাক-পরিচ্ছদ, শরীর-চর্চা, হাসি, কান্না, বাথরুম ব্যবহার, তাকানো ইত্যাদি থেকে শুরু তার সকল কার্য প্রণালি উৎকর্ষ মনন সৃষ্টির সহায়ক। মনন চাষের এমন উন্নত নমুনার দ্বিতীয় উদাহরণ বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে বিস্তর আলোচনায় না গিয়ে চুম্বক দু’একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেই আমরা সমাপ্তি ও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করব।

** রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৌতুক পছন্দ করতেন, কৌতুক করতেন। তবে মিথ্যা বলতেন না।

** হাসির কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসতেন। তবে দাঁত কেলিয়ে হাসতেন না। সৌজন্য হাসি দিতেন। দৃষ্টিনন্দন মুচকি হাসতেন।

** তিনি যখন কথা বলতেন তা স্পষ্ট করে বলতেন। প্রয়োজনে তিনবার বলতেন। বিষয়কে গুরুত্ববহ করতেন।

** কারো দিকে তাকানোর সময় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেন না। গোটা দেহ ঘুরিয়ে তাকে দেখতেন।

** তিনি যখন পথ চলতেন, দম্ভভরে হাঁটতেন না। কাঁধের দুই পাশ দুলিয়ে বিনয়ের সাথে পথ চলতেন।

** চুল, দাড়ি, গোঁফ, নখের নিয়মিত পরিচর্যা করতেন। যাতে তা খুশকি, উকুন, ময়লা ও জীবানুর অভয়ারণ্য হতে না পারে।

** কখনও কারো ভেঙচি বা টিপ্পনি কাটতেন না, গালি দিতেন না, উপহাস করতেন না, ছোট করতেন না, হক নষ্ট করতেন না।

** জীবনে কখনও মিথ্যা বলেননি। কোনো প্রার্থীকে বঞ্চিত করেননি।

** ছোটদের স্নেহ করতেন, বড়দের শ্রদ্ধা করতেন, মুরুব্বিদের মান্য করতেন।

** তিনি কর্কশভাষী ছিলেন না, উচ্চাভিলাষী ছিলেন না।

** তিনি সাথীদের প্রতি ছিলেন রহমদিল, শত্রুর প্রতি ছিলেন কঠোর।

** লজ্জা, সৌজন্যতা, বিনয় ছিল তার চরিত্রের অন্যতম ভূষণ।

** তার দৃষ্টি থাকত সদা সংযত, মুষ্ঠি থাকত সদা সংহত, হস্ত থাকত সদা প্রসারিত, মন থাকত সদা প্রশস্ত, অন্তর সর্বদা বিশ^স্ত।

** স্ত্রীর জন্য আদর্শ পতি, সন্তানের জন্য আদর্শ পিতা, দাসের জন্য আদর্শ মনিব, বাবা-মায়ের আদর্শ সন্তান, বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত, প্রতিবেশির কাছে আশ্বস্ত, শত্রুর জন্যও আমানতদার, ইজ্জত-সম্ভ্রমের রক্ষক, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর অনুগত বান্দা।

** তিনি হেলান দিয়ে খেতেন না। কেননা তা পাচকের প্রতিবন্ধক।

** তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরে কারো সাথে কথা বলতেন না। কেননা তা মনোযোগ বিনষ্টকারী।

** তিনি জনসমাগম হতে দূরে না গিয়ে বাথরুম করতেন না। কেননা তা লজ্জা অনাবৃতকারী।

** তিনি খাবার চিবিয়ে তারপর গিলতেন। কেননা তা হজম সহায়ক।

** তিনি কষ্ট পেলে কাঁদতেন। তবে হাউমাউ করতেন না। কারণ তা পরিবেশ শৃংখলা নষ্টকারী।

** তিনি নিয়মিত গোসল করতেন, তৈল লাগাতেন, চিরুনী করতেন, সর্বদা পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন। কেননা তা সৌন্দর্য ও সৌজন্য প্রকাশক।

** তিনি নেশা দ্রব্য সেবন করতেন না। কেননা তা মস্তিস্কে উন্মাদনা আনে।

** তিনি কারো ইজ্জত হরণ করতেন না। কারণ তা দৃষ্টিকটু ও লজ্জার।

** তিনি শিক্ষাকে সর্বদা উৎসাহ দিতেন। কারণ তা সমাজের শুদ্ধি স্মারক।

** সকলের মতামতকে সম্মান করতেন। প্রয়োজনে তা গ্রহণ করতেন। কারণ তা উদার গণতন্ত্রের উন্মেচক।

** সর্বক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল। কারণ তা সফলতার উদ্বোধক।

** তিনি কঠোরভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। কারণ তা অনিষ্টের মূল।

** তিনি মিথ্যা চর্চা করতেন না। কারণ তা সকল অপরাধের জননী। (উপরের সকল বক্তব্য হাদিসের সার নির্যাস থেকে গৃহিত)

এমনি আরো অসংখ্য বিষয়ের উল্লেখ আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। যার সর্বত্র কেবলই ইতিবাচকতার প্রলেপ। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিত্যতায় চরিত্রের আরো সহস্র-অযুত অধ্যায় রয়েছে যা কেবলই শুদ্ধ মননের সুবাস ছড়ায় প্রতিনিয়ত। যত সময় পেরুচ্ছে, গবেষণা বিশেষায়িত হচ্ছে রাসুল চরিতের অমূল্য সৌরভ ততই বিচ্ছুরিত হচ্ছে আরো অধিক মাত্রায়। এই সুবাস এবং সৌরভ কেবলই শুদ্ধ মননের ফেরি করে। বিশুদ্ধ মানসের চাষ করে। চরিত্রিক বিশুদ্ধতা উস্কে দেয়। মানব মনে ছুঁয়ে দেয় পবিত্রতার প্রলেপ।

মানুষের মানসকে বিকশিত ও মননকে উৎকর্ষ করতে সর্বাধিক প্রভাবিত করে তার চিন্তাভ্যাস। উপযুক্ত তিনটি প্যাটার্ন বা অভ্যাসকে নির্দিষ্ট রেখায় পরিচালিত করতে যে অভ্যাস নেপথ্যে থেকে সর্বাধিনায়কের ভূমিকা পালন করে তা হলো তার চিন্তাভ্যাস। তাই মনন বা মানসকে শুদ্ধ করবার আগে চাই চিন্তার পরিশুদ্ধির পরিকল্পনা। নতুবা যে কোনো মুহূর্তে সে একমাত্রিক, একরৈখিক বা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবার সম্ভাবনা প্রবল। তবে কারো চিন্তার মাপকাঠি যদি সঠিক হয়, তবে তার লাইনচ্যুত হবার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ মনন চাষের গোঁড়ার কথা হচ্ছে চিন্তার চাষ। চিন্তার আঙ্গিক, পরিধি, পরিসীমা ও আয়তন নির্ধারণ। আমি কী চিন্তা করব? কতটুকু করব? কিভাবে করব? কতদূর করব? কেন করব? এর লাভ বা ক্ষতি কী হতে পারে? ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যদি আমরা প্রথমেই পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত, নিয়ন্ত্রিত করতে পারি তাহলেই আমাদের চিন্তা সঠিক পথে চলবে, তা মানস গঠন সহায়ক হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ বান্দাকে কখনই তার সাধ্যাতীত চাপ প্রয়োগে অতিষ্ট করেন না।

সুতরাং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাধ, সাধ্য, আকাক্সক্ষা, বাস্তবতা ইত্যাদির আলোকেই তিনি চিন্তামানসকে ধারণ করেছেন, তার অনুসারী ও পরবর্তি প্রজন্মের জন্য মাপকাঠি নিরূপন করে দিয়েছেন। যাতে কেউ বাহুল্যকষ্টে নিপতিত না হয়। অযাচিত পরিশ্রম যেন কাউকে অবসন্ন করতে না পারে। কারণ আমাদের বিবেচনায় সমগ্র বিশ্বের সমূহ শিক্ষার আদি ধারণা হলো- কেউ কারো মতো নয়। কেউ কারো বাধার সৃষ্টি করবে না। যদিও সবার উপাদান ও উপকরণ এক। বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করতে বলতে চাই- গ্রহ, নক্ষত্র, গ্রহানুপঞ্জ বা আরো যা কিছু আছে তাদের সকলের স্বতন্ত্র পথ ও পদ্ধতি আছে। তাই চলাচলে কেউ কারো বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায় না। আল্লাহ বলেন-

لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া। এবং রাত্রির পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা। আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। [সূরা ইয়াসীন : ৪০] তাদের কারো সাথে কারো সাক্ষাৎ হয় না। কেউ তার নিজের রাস্তা ছেড়ে অন্যের রাস্তায় চলাচল শুরু করে না। কেউ তার পথ হতে চ্যুত হয় না। অর্থাৎ সবাই তার নির্ধারিত পথ তথা সীমানা তথা হুদুদকে মেনে চলে। তাই কোনো দুর্ঘটনা বা দৈবপাক পরিলক্ষিত হয় না। একই অর্থে পৃথিবীর মানুষও যদি যার যার সীমানা তথা হুদুদ মেনে চলে তাহলে সেখানেও কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে না। হতে পারে না। এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম।

সেজন্যই আপন মননকে পরিশুদ্ধ করতে স্বীয় হুদুদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং পরিশীলিত চিন্তাই একজন মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর মানুষের মানবদেহের চিকিৎসক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন মনের চিকিৎসক। মানসিকতা পরিশোধনের মহান শিক্ষক। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল-কুরান আল-কারিমে স্পষ্টরূপে এরশাদ করেন-

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ

তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য হতে রাসুল প্রেরণ করেন যিনি তেলাওয়াত করেন তাদের সামনে তার আয়াত। তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন। আর তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিদায়াত। [সূরা জুমুআ : ২]  তিনি মানব জাতির মহান শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হবার অর্থ হলো তিনি ছিলেন মানব জাতির মনো-শিক্ষক। কারণ প্রথাগত অক্ষর-জ্ঞান তার ছিলে না।

তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন মানবের মননকে পরিশুদ্ধ করতে। প্রতিটি মানুষের ধারণ ক্ষমতা যেহেতু আলাদা। তাই প্রত্যেককে দিয়েছেন আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপনা। যেমন কেউ এসে জিজ্ঞেস করেছেন- ইসলামের সর্বোত্তম আমল কী? তিনি তাকে বলেছেন- অপরকে বা অভূক্তকে খাদ্য খাওয়ানো। একই প্রশ্নের জবাবে অন্যকে বলেছেন- পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া। একই প্রশ্নের জবাব দুই রকমের হলো কী করে? হলো এই জন্য যে উত্তরদাতা জানতেন কার কোন চিকিৎসা প্রয়োজন। যার যার শুন্যতা পূরণে প্রদত্ত হয়েছে মহানবির যথোচিত জবাব।

আবার এক ব্যক্তি এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলেছেন আমাকে এমন আমলের সংবাদ দিন যা আমাকে সহজেই জান্নাতে নিয়ে যাবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কেউ জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জিহাদে যেতে চাইলে তিনি তাকে তার বাবা-মার খেদমতের নসিহত দিয়েছেন। এটিই মূলত মনো-চিকিৎসা। যার ক্ষত যেখানে তিনি ঔষধ দিয়েছেন সেখানে।

ব্যষ্টিক পর্যায়ে এইভাবেই সবাইকে এমন দীক্ষা দিয়েছেন যে তারা তাদের মননকে যথাযথ মানে উৎকর্ষ করবার পথ নির্দেশনা পেয়েছেন।

সামষ্টিক পর্যায়ে তার মনন চিকিৎসার ধারা আরো অনবদ্য। বিশেষত তার মাক্কি জীবনের পুরোটা জুড়েই রয়েছে এই কাজের ব্যাপৃতি। আল্লাহ বলেন-

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا- وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا

অবশ্যই সেই সফলকাম যে তাকে উৎকর্ষ করেছে। আর অবশ্যই সে যে তাকে অবদমিত করেছে। [সূরা আশ শামস : ১০] তিনি সর্বদাই আত্মগঠন ও মানস গঠনের উপর জোড় দিয়েছেন। মানস গঠনের উপাদান উপস্থাপন করেছেন মানব জাতির সামনে। আল-কুরান আল-কারিম-এ উদ্ধৃত হয়েছে-

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ- الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ- إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ- فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ- أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ- الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অবশ্যই সফলতা মুমিনদের। যারা সালাতে বিনয়ী হয়। বেহুদা কাজ হতে দূরে থাকে। জাকাত আদায়ে থাকে সক্রিয়। যৌন জীবন পরিচালনায় তারা অতি মাত্রায় সুশৃংখল। … যারা আমানত ও প্রতিশ্রæতি রক্ষা করে। … তারাই হবে জান্নাতের উত্তরাধিকার। তথায় তারা থাকবে চিরকাল। [সূরা আল মুমিনূন : ১-১১]

এ আয়াতসমূহে যে মানবিক গুনাবলীর কথা বলা হয়েছে তা প্রকারান্তরে মনন শুদ্ধির অব্যর্থ ব্যবস্থাপত্র। এখানে ব্যক্তির নৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে প্রাধান্য দেবার পাশাপাশি ব্যক্তি আভিজাত্যের বিষয়টিকেও উচ্চকিত করা হয়েছে।

আদি ও সর্ব প্রাচীন আদর্শের নতুন প্রচারে নিমগ্ন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নানা তির্যক প্রশ্নবানে নিপিষ্ট করতে চাইতো তদানীন্তন জনগোষ্ঠী। অযাচিত ও অনর্থক বিষয়ে এলোমেলো প্রশ্ন করতে থাকলে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুকাবিলা করেন যথা সতর্কতায়। যেমন কিয়ামত কবে হবে? এ প্রশ্ন তাদের সকলের এবং বারংবারের। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিয়ে বিতর্ক জমাতে চাননি। বরং কিয়ামাতের আবহ, পরিবেশ এবং প্রস্তুতির প্রসঙ্গ এনে মননের যুৎসই চিকিৎসা করতে চেয়েছেন অভিনব পন্থায়। সুরা নাবার পুরোটা জুড়ে রয়েছে এর নান্দনিক বর্ণনা। সুরার শুরু হয়েছে এভাবে-

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ  عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ  الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ  كَلَّا سَيَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلَّا سَيَعْلَمُونَ

তারা জানতে চায় মহাসংবাদ তথা কিয়ামাত সম্পর্কে। এ নিয়ে তাদের রয়েছে মতানৈক্য। তবে শীঘ্র তারা জানতে পারবে। অবশ্যই তারা জানতে পারবে। [সূরা নাবা : ১-৫] এরপর বলা হয়েছে তাদের সৃষ্টিতত্ব। আনা হয়েছে নিদ্রা ও রাত্রির প্রসঙ্গ। আসমান, জমিন, সূর্যের প্রসঙ্গ। এবারে শুরু করা হয়েছে কিয়ামাতের আলামতের বর্ণনা। শেষত পাপীদের জন্য জাহান্নাম আর পূণ্যবানদের জন্য জান্নাতের অনবদ্য বর্ণনা।

আয়াতের ধারাবাহিক মূর্চ্ছণা তরঙ্গে মনে হয় যেন কিয়ামতের দিন-তারিখ বলা হয়ে গেছে। আয়াতের প্রতিবেশে যেন সবাই কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু না আয়াতে তা করা হয়নি। আয়াতে সকলের মননকে সচকিত করা হয়েছে- জান্নাত পেতে কিংবা জাহান্নাম থেকে বাঁচতে তোমার প্রস্তুতি কী? যদি তোমার প্রস্তুতি না থাকে তবে দিন-তারিখ জেনে লাভ কী? এ আয়াতগুলোতে অত্যন্ত কৌশলে অবিশ্বাসী মস্তিস্কে আঘাত করা হয়েছে। যা সৃজনশীল মনন সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রাকৃতিক দাওয়াত, দাওয়াতের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন, অস্বীকারকারীদের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব, বিভিন্ন উপমা প্রদানের পরও অতুষ্ট অবিশ্বাসী সম্প্রদায় বুঝেও না বুঝার ভাণ করে তখনই তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাদেরকে অন্তরহীন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে লাভ হয়েছে- বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর মনন উৎকর্ষতর হয়েছে। তাদের বিশ্বাস প্রগাঢ় হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ

তাদের রয়েছে অন্তর তবে তা দ্বারা তারা বুঝে না। তাদের রয়েছে চক্ষু তবে তা দ্বারা তারা দেখে না। তাদের রয়েছে কান তবে তা দ্বারা তারা শুনে না। বস্তুত তারা চতুষ্পদ প্রাণী তুল্য। বরং তার চেয়েও অধম। [আরাফ : ১৭৯]

সমাজ সংসারে যাবতীয় অশান্তির মূল কারণ হয়েছে- ভীতিহীনতা, জবাবদিহিতার প্রটোকলের বাইরে থাকা। এমন সুযোগ এবং সুবিধা পেলেই মানুষ বখে যায়, তার অন্যায়ের দৌরাত্ম বেড়ে যায়, সে যাচ্ছেতাই করে বেড়ায়। এ সকল অন্যায়-অপকর্ম নিয়ন্ত্রনে পার্থিব যত আইনই করা হোক কেন ক্ষমতা, প্রতাপ, প্রতিপত্তি দিয়ে তা পাশ কাটানোর সুযোগও থাকে। বরং প্রায়শ তাই হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে এই পৃথিবী পরিণত হয় অন্যায়ের স্বর্গরাজ্যে, অশান্তির অভয়ারণ্যে। প্রত্যেক অপরাধীর অপরাধের নেপথ্যে কাজ করে অপরাধীর এ ধারণা যে- এই পৃথিবীই তার জীবনের শেষ। ক্ষমতা আর প্রতাপে এই জীবন পার করতে পারলেই ব্যাস। আর কোনো চিন্তা নেই। ফলে সে তার অপরাধে হয় বেপরোয়া। কিন্তু ইসলাম এ ধারণাকে ভ্রান্ত বলেছে। বলেছে- দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। রয়েছে এরপরে অনন্ত জীবন। সেই জীবন হবে এই জীবনের কর্মের প্রতিফল প্রাপ্তির জীবন। এই জীবন উত্তম হলে পরের জীবন হবে আনন্দময়। এই জীবন কলঙ্কের হলে পরের জীবন হবে বিষাদময়। কী চমৎকার আল্লাহর বাণী-

بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى

তারা তো প্রাধান্য দেয় দুনিয়ার জীবনকে। অথচ আখিরাতের জীবনই সর্বোত্তম ও চিরস্থায়ী। [সূরা আলা : ১৬-১৭] সুতরাং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণই হবে বুদ্ধিমত্তার।

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই দুনিয়াকে পাপ ও দুষণমুক্ত করতে চেয়েছেন। পরকালীন জবাবদিহিতার প্রগাঢ় নিশ্চয়তা দিয়ে জনমানুষকে সতর্ক জীবন যাপনে আগ্রহী করেছেন। তার মননকে পবিত্র করতে ঘোষণা করেছেন-اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا  পড়ো, তোমার আমলনামা। তোমার জবাবদিহিতার জন্য আজ তুমিই যথেষ্ট। ১৭: ১৪; এই চিন্তা যদি কারো মাথায় ঘুরপাক খায় তাহলে কি তার দ্বারা আর কোনো পাপ করা সম্ভব হবে? শুধু আমলনামা পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে মননকে আরো সক্রিয় ও আল্লাহমুখি করতে আরো ঘোষণা করা হয়েছে-

فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ  وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ

আর যে অনু পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তাও দেখতে পাবে। আর যে অনু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সে তাও দেখতে পাবে। ৯৯: ৭-৮;

এ আয়াতে প্রতিটি কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করানোর দিব্য ঘোষণা মনন শুদ্ধিকরণের অনন্য হাতিয়ার হয়েছে। কারণ মানুষ এই দুনিয়াতে যা কিছু করবে তার সবই সেদিন ভিডিও বা ফিল্ম এর মাধ্যমে তা উপস্থাপিত হবে। এ বিশ্বাস যে মননের গভীরে প্রোথিত হয় সে মনন কি কখনও অপরাধে প্রলুব্ধ হতে পারে? অবশ্যই পারে না। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গৃহিত প্রতিটি পদক্ষেপই মনন সংস্কারে যে অভাবনীয় সফলতা এনেছে সত্যিই তা বিস্ময়কর।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি ঘোরতর অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। যেমন- চুরির জন্য হাত কেটে দেওয়া, ব্যভিচারের জন্য র্দোরা মারা বা পাথর মেরে হত্যা করা। এ দুইটি অপরাধের শাস্তিই ইসলামে ভয়াবহতর। কারণ জঠর জ্বালা ও যৌন জ্বলার নিবৃত্তির অপরাধই সমাজে বেশি হয়ে থাকে। তাই এদের শাস্তিও ভয়াবহ। প্রকাশ্যত এটি দেখে অমানবিক মনে হতে পারে। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শাস্তি প্রবর্তনের পশ্চাতেও ছিল মানব মনের সুচিকিৎসা ও সমাজ হতে অপরাধের অবলুপ্তি। এই অপরাধদ্বয়ের আইনও তাই কঠোর। আর তা কার্যকরের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন নিরাপোষ। তবে তার দীর্ঘ জীবনে একটির বেশি এ অপরাধের শাস্তি কার্যকর করতে হয়নি। কারণ এ বিধান মানব মনে এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তারা ঐ পাপের প্রতি প্রবৃত্তই হয়নি। এমন মনন তৈরী করতে পেরেছিল মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চিন্তা-দর্শন।

এভাবে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গোটা সিরাত অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে- এ পৃথিবীকে অপরাধমুক্ত করতে, দুনিয়ার জীবনকে শান্তিময় করতে, মানব জীবনকে শঙ্কামুক্ত করতে, জীবনকে অর্থবহ করতে, সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করতে, এই পৃথিবীকে নিরাপদ ও আবাসযোগ্য করতে তিনি যত কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন তার সবগুলিই মননের সংস্কারে নিবেদিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, নৈতিকতার সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার বা আরো যত সংস্কার আছে সকল সংস্কারের নেপথ্যে ছিল তদানীন্তন ও আগত প্রজন্মের মনন সংস্কার। মনন সংস্কারের কর্মসূচি যার যতটা সফল, প্রভাব বিস্তারকারী নেতা হিসেবেও তিনি ততটাই সফল। তাই আমরা দিগ্বিজয়ী চিন্তানায়কদের দেখেছি- তারাও মনন সংস্কারে মনোযোগি হয়েছেন। উত্তর প্রজন্মের জন্য তারা নানান দর্শন, চিন্তাধারা, বিবৃতি, ভাষ্য, নির্দেশনা রেখে গেছেন। তবে তাদের সফলতার হার অত্যল্প। কারণ তাদের সংস্কার চিন্তার অন্তরালে ছিল চারিত্রিক দৈন্য, বুদ্ধির অপক্কতা, চিন্তার একদেশদর্শিতা, বিশেষ মতবাদের প্রতি একরৈখিকতা, ভাবনার অন্তসারশুন্যতা। সর্বোপরি আসমানি নির্দেশনার অভাব তো ছিলই। আমরা তাদের কারুরই নাম করছি না।

রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উপর্যুক্ত সকল অপূর্ণতা থেকে মুক্ত ও স্বচ্ছ চারিত্রিক গুনের আধার। তাই তিনি উপবেশন করেছেন সফল মনন সংস্কারকের কুরসিতে। খোদায়ী নির্দেশনায় তিনি যে সুক্ষ্মদর্শিতার প্রমাণ রেখেছিলেন তাও তার মনন সংস্কারের সফলতায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শুদ্ধি ও সংস্কার জগতবাসির মন জয় করেছিল। তৎপ্রতি সকলকে আকৃষ্ট করেছিল। আজও তার সংস্কার সকলকে ভাবায়। বিস্ময়াভিভুত করে। এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা হয়রান হয়ে যায়। আমরা মনে করি সকল আকর্ষণ, বিস্ময় কিংবা দৃষ্টি প্রক্ষেপের গোড়ার কথা হলো- তার মনন সংস্কার। আমরা আরো মনে করি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মননের সংস্কারক হিসেবে অদ্বিতীয়। মানসের কর্ষণকারী হিসেবে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দক্ষ। মনন বুঝে যুৎসই দাওয়া প্রদানে অব্যর্থ ও অবিকল্প। মন, মনন, মানস ও অন্তরের সংস্কারে তার জীবনও ছিল অনুকরনীয়, সুমহান। মহান আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ

আর হে নবি নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।[সূরা ক্বলম : ৪] তিনি তার সর্বোত্তম আদর্শ সম্পর্কে বলেন-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। [সূরা আহযাব : ২১] তিনি আমাদের মননের সর্বোৎকৃষ্ট সংস্কারক ছিলেন বলেই তিনি আমাদের আদর্শিক নমূনা। তাই প্রভূ সমীপে তব কায়োমনো আবেদন-

মুমিন অন্তরের সকল ভালোবাসা নিঃসৃত হোক মনন সংস্কারক রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অসীম শ্রদ্ধায়, নিখাঁদ আন্তরিকতায়। সাল্লি আলা মুহাম্মদ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

প্রবন্ধকার – ড. কামরুল হাসান
প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights