সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

রাসুলুল্লাহ সা: এর আগমন : যেন আঁধারে আলোর ঝলকানি

গোটা দুনিয়া অন্ধকারে ডুবে ছিলো। ধর্মীয় বিশ্বাসে ভ্রান্তিতেই ছিলো অধিকাংশ মানুষ। সামাজিক মূল্যবোধ বলতে কিছু ছিলো না। চারিত্রিক অবস্থা ছিলো অধ:পতিত। অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিলো। রাজনৈতিক অবস্থাও ছিলো নাজুক। শাসকবর্গ বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলো। প্রজা শ্রেণী ছিলো মযলুম। অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’য়ালার অপার কৃপায় দুনিয়ায় আসেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা:)। তাঁর আগমন যেন অন্ধকারে আলোর ঝলকানি। পৃথিবী তাঁর আগমনী বার্তা পাওয়ার আশায় যেন ব্যাকুল ছিলো!

জাফর (রা.) মুখে রাসূল (সা.) এর আগমনের পূর্বের অবস্থার চিত্র:

বাদশাহ নাজ্জাশির সাথে জাফর (রা:)-এর কথোপকথন থেকে আল্লাহর রাসুলের আগমনের পূর্বের অবস্থা এবং তাঁর আগমন পরবর্তী অবস্থা সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। হাবশায় হিজরত সম্পর্কে উম্মে সালমা (রা:) থেকে সেই বর্ণনা পাওয়া যায়। উক্ত কথোপকথনে জাফর (রা:) বলেন: হে বাদশাহ! আমরা অজ্ঞ জনগোষ্ঠী। মূর্তিপূজা করতাম। মৃত প্রাণী ভক্ষণ করতাম। অশ্লীল কাজ করতাম। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম। প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ করতাম। আর আমাদের সবল লোকজন দুর্বলদের শোষণের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিতো। এ অবস্থায় আল্লাহ আমাদের নিকট এমন এক রাসূল প্রেরণ করলেন, যাঁর বংশ পরিচয়, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও পরিচ্ছন্নতা আমাদের মধ্যে সুবিদিত।

তিনি আমাদেরকে মহান আল্লাহর দিকে ডাকলেন, যেন আমরা তাঁর একত্ববাদ মেনে নিই। তাঁর দাসত্ব করি এবং আমাদের পিতৃপুরুষগণ আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মূর্তি ও পাথরের পূজা করতেন, আমরা যেন তা পরিত্যাগ করি। তিনি আমাদেরকে আদেশ দিলেন আমরা যেন সত্য কথা বলি, আমানত রক্ষা করি, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখি, প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করি ও নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন এবং রক্তপাত ঘটানো থেকে বিরত থাকি। আর অশ্লীলতা, মিথ্যা কথা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ ও সতী নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ; এসব কাজ করতে তিনি আমাদের নিষেধ করলেন। হাইসামি বলেন, হাদীসটি আহমাদ, তাবারানী ও বাযযার বর্ণনা করেছেন। [সীরাতুন নবি: শায়খ ইবরাহীম আলী]। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: জাহেলী যমানার চারটি বিষয় আমার উম্মতরা (সম্পূর্ণরূপে) পরিত্যাগ করবে না। তা হলো, নিজ বংশের আভিজাত্যের গৌরব, অপরের বংশ পরিচয় নিয়ে কুৎসা রটনা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা এবং বিলাপ করা। [মুসলিম, আহমাদ; বায়হাকী]।

জাহেলী যুগে আরবদের মাঝে মূর্তি পূজা প্রাধান্য পেয়েছিলো। যদিও একসময় তারা দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী ছিলো। হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর দাওয়াতের প্রভাবে যথেষ্ট অনুগত ছিলো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তাদের মাঝে পরিবর্তন আসলো। মূর্তি পূজাতেই অধিকহারে মনোনিবেশ করলো। হোবল, মানাত ও ওযযা ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় মূর্তি। শিরকের ভয়াবহতায় তারা ডুবে ছিলো। পৌত্তলিকরা কাবাঘরেও মূর্তি স্থাপন করে। মক্কা বিজয়ের সময় কাবা ঘরে তিনশত মূর্তি পাওয়া গিয়েছিলো। বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ  আর রাহীকুল মাখতূম-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়: জাহেলিয়াত যুগের পৌত্তলিকদের মধ্যে মূর্তি পূজার বিশেষ কিছু নিয়ম প্রচলিত ছিলো। এর অধিকাংশই ছিলো আমর ইবনে লুহাই-এর আবিস্কার। লোকেরা আমর ইবনে লুহাইয়ের আবিস্কারসমূহকে ইব্রাহীমের দ্বীনের পরিবর্তন নয়; বরং এসবকে তারা মনে করতো বিদয়াতে হাসানাহ।

মূর্তি পূজার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেওয়াজ প্রথা তুলে ধরা হচ্ছে-

এক.

আইয়্যামে জাহিলিয়াতে পৌত্তলিকরা মূর্তির সামনে নিবেদিত চিত্তে বসতো এবং তাদের কাছে আশ্রয় চাইতো। তারা বিশ্বাস করতো, মূর্তিরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করিয়ে দেবে।

দুই.

জাহেলিয়াত যুগের মূর্তিপূজারীরা মূর্তিগুলোর উদ্দেশ্যে হজ্জের তাওয়াফের মতো তাওয়াফ করতো। তাদের সিজদাহ করতো।

তিন.

মূর্তিগুলোর জন্য কুরবানী ও নযরানা পেশ করা হতো। কখনো কখনো মূর্তির আস্তানায় নিয়ে কুরবানীর পশু জবাই করা হতো। তবে সেটা করা হতো মূর্তির নামে। জবাইয়ের এ উভয় প্রকারের ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা : (সে পশুও হারাম) আর যা মূর্তির বেদীর উপর বলী দেয়া হয় তা। [৫. সূরা আল-মায়েদাহ: ৩] ইবনে কাসীরের বর্ণনায় এসেছে: ঐ জন্তু, যাকে নুছুবের উপর যবেহ করা হয়। নুছুব ঐ প্রস্তর বা বেদীকে বলা হয়, যা কাবা গৃহের আশেপাশে স্থাপিত ছিলো। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা এদের উপাসনা করতো এবং এদের উদ্দেশ্যে জন্তু কুরবানী করতো। একে তারা ইবাদাত বলে গণ্য করতো। জাহিলিয়াত যুগের আরবরা উপরোক্ত সব প্রকার জন্তুর গোস্ত ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিলো। আল্লাহ তা’য়ালা এগুলোকে হারাম করেছেন।

চার.

মূর্তির সন্তুষ্টি লাভের একটা উপায় এটাও ছিলো যে, পৌত্তলিকরা তাদের পানাহারের জিনিস, উৎপাদিত ফসল এবং চতুষ্পদ জন্তুর একাংশ মূর্তির জন্য পৃথক করে রাখতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা আল্লাহর জন্যেও একটা অংশ রাখতো। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দেন: আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন সে সবের মধ্য থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের শরীকদের জন্য। অতঃপর যা তাদের শরীকদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের শরীকদের কাছে পৌঁছায়, তারা যা ফয়সালা করে তা কতই না নিকৃষ্ট। [৬. সূরা আল-আনয়াম: ১৩৬]। এ আয়াতে মুশরিকদের একটি বিশেষ ভ্রষ্টতা তুলে ধরা হয়েছে। এরকম আরও অনেক ভ্রান্ত ধারণা জাহিলিয়াত যুগে পৌত্তলিকদের মাঝে বিরাজমান ছিলো।

জাহেলী যমানায় মানুষগুলো জঘন্য প্রকৃতির ছিলো। তারা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিতো। নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো? [৮১. সূরা আত-তাকভীর: ৮-৯]। জাহেলিয়াত যুগের কোনো কোনো আরব গোত্র কন্যা সন্তানকে লজ্জাকর মনে করতো এবং জীবন্তই মাটিতে প্রোথিত করে দিতো। [ইবনে কাসীর, কুরতুবী]। পরবর্তীতে ইসলাম এই কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে। ৯ নং আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এই আয়াতের বর্ণনাভঙ্গিতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যায়। যে পিতা বা মাতা তাদের মেয়েকে জীবন্ত প্রোথিত করতো, আল্লাহর কাছে তারা এতো বেশী ঘৃণিত যে, তাদেরকে সম্বোধন করে একথা জিজ্ঞেস করা হবে না, তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছিলে কোন অপরাধে? বরং তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছিলো? [ইবনে কাসীর]।

এরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশকে আমূল পরিবর্তন যিনি করলেন, তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা:)। আল্লাহর তা’য়ালার পক্ষ থেকে ইলমুল ওহী’র আলোয় তিনি দুনিয়াকে আলোকিত করেছিলেন। বিখ্যাত অনেক অমুসলিম ব্যক্তিদের উক্তি থেকেও পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়, বিশ্বনবী কতটা মহান ও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মন্তব্য: মুহাম্মদ (সা:) আরববাসীদের ঐক্যের দীক্ষা দিয়েছেন। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ নিরসন করেছেন। অল্প কিছু দিনের ভেতর তাঁর অনুসারী উম্মত বিশ্বের অর্ধেকের চেয়েও অধিক অংশ জয় করে ফেলে। পনেরো বছর সময়ের মধ্যে আরবের লোকেরা মূর্তি এবং মিথ্যা দেবতাদের পূজা থেকে তওবা করে ফেললো। মাটির মূর্তি মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া হলো। এ বিস্ময়কর সাফল্য মুহাম্মদ (সা:)-এর শিক্ষা ও তাঁর অনুসরণের কারণেই হয়েছে। টমাস কার্লাইলের মন্তব্যটিও চমৎকার: আঁধার থেকে আলোর পথের দিশারী ছিলেন মুহাম্মদ (সা:)। আমি বলছি, স্বর্গের জ্যোতির্ময় আলো ছিলেন এ মহান ব্যক্তি। বাকী সকল লোকেরা ছিলো জ্বালানীর মতো। পরিশেষে তারাও পরিণত হয়েছিলো আগুনের স্ফুলিঙ্গ। [অন্যদের চোখে আমাদের প্রিয়নবী]। আজকের অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে শাশ্বত জীবনাদর্শ; হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কে অনুসরণ এবং তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই।

লেখক: মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার,

বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights