সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

ঈমান শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় ; বরং কর্মের ও

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ: স্বীকার করা, স্বীকৃতি দেওয়া, মতান্তরে দৃঢ় বিশ্বাস করা। ইবনে তাইমিয়া রহঃ :التصديق مع الأمن এমন স্বীকৃতি যার মধ্যে নিরাপত্তা থাকবে। ঈমানের বিপরীত শব্দ হলো কুফর। আর কুফর অর্থ : অস্বীকার করা। ঈমানের পারিভাষিক অর্থঃ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের নাম হ’ল ঈমান। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা’।

ঈমানের অংশ

أجزاء الإيمان الثلاثة كأجزاء الإنسان: (শরীরের যেমন তিনটি অঙ্গ, ঈমানের তেমনি তিন অংশ)

ঈমান হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আমলের নাম। অর্থাৎ অন্তর ও জবানের স্বীকারোক্তি এবং অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মকে ঈমান বলা হয়। আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপ কাজের মাধ্যমে তা কমে যায়। ঈমানের মধ্যে মু’মিনগণ পরস্পর সমান নয়; বরং তাদের একজন অপরজনের চেয়ে কম বা বেশী মর্যাদার অধিকারী। ঈমানের রুকন ও ঈমান-ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে আমাদের জানতে হবে। স্বীকারোক্তি এবং আমল- এ দু’টির সমষ্টির নাম ঈমান, এর কোন দলীল আছে কি? এ ব্যাপারে যথেষ্ট দলীল রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمْ الإيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ “কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তোমাদের অন্তরে ঈমানের মুহাববত সৃষ্টি এবং তা তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন’’ (সূরা হুজরাতঃ ৭)

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ “তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন কর’’। (সূরা আ’রাফঃ ১৫৮) এটিই হচ্ছে (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং (محمد رسول الله– মুহাম্মাদুর্ রাসূলুল্লাহ) এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ। এ দু’টি বিষয়ের সাক্ষ্য য়া ব্যতীত কোন বান্দাই ইসলামে প্রবেশ করতে পারে না। বিশ্বাসের দিক থেকে উপরোক্ত দু’টি বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়া অন্তরের কাজ এবং উচ্চারণের দিক থেকে বিচার করলে এ দু’টি জবানের কাজ। অন্তর এবং জবানের স্বীকারোক্তি ও আমল এক সাথে পাওয়া না গেলে ঈমান হবে মূল্যহীন।

আমলের অপর নাম যে ঈমান সে দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ ‘‘আল্লাহ তোমাদের ঈমানকে নষ্ট করবেন না’’। (সূরা বাকারাঃ ১৪৩) অর্থাৎ কিবলা পরিবর্তনের পূর্বে বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে তোমাদের আদায়কৃত নামাযকে নষ্ট করবেন না। আল্লাহ তা’আলা এখানে নামাযকে ঈমান বলে নামকরণ করেছেন। আর নামায হল অন্তর, জবান এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মের সমষ্টিগত নাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেহাদ, লাইলাতুল কদরের এবাদত, রামাযানের রোজা, তারাবীর নামায এবং গণীমতের মালের এক পঞ্চগোশত দান করে দেয়া এবং অন্যান্য আমলকে ঈমান হিসাবে গণ্য করেছেন।

কোন আমলটি উত্তম

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ أَيُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ إِيمَانٌ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ “কোন্ আমলটি উত্তম? তিনি বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।” ঈমানের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। অনেক অনুবাদক আরবি শব্দ ‘ঈমান’ কে ‘বিশ্বাস’ হিসেবে অনুবাদ করেন। এই অনুবাদটি অনেকটা কঠিন সমস্যার একটি অপূর্ণ সমাধানের মত। দুর্ভাগ্যক্রমে, আরবি থেকে ভাষান্তরের সময় প্রায়শই ভুল অনুবাদ পাওয়া যায়। এই ভাষাতাত্ত্বিক অঙ্গনের অন্যতম করুণ উদাহরণ হল “জিহাদ” শব্দটি, যা একটা সময় “পবিত্র যুদ্ধ” হিসাবে অনুবাদ করা হত।

মুসলিমরা নিজেরাই ঈমানকে ‘বিশ্বাস’ হিসাবে অনুবাদ করছে। ‘বিশ্বাস’ হিসাবে ঈমানের অনুবাদ এতটা সমস্যাযুক্ত কারণ, যদি কোনো মুসলিম যদি মনে করে যে কুরআন তাকে ঈমান রাখার আদেশ দিয়েছে, আর সে যদি ‘বিশ্বাস’ অনুবাদের দিকে তাকিয়ে শুধু অন্তর থেকে বিশ্বাস রাখে আর কোনো ধর্মীয় দায়িত্ব পালন না করে তবে তা তার ধ্বংসের জন্য একটি ভয়াবহ কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ঈমানের অর্থ আরও বিস্তৃত যা ‘বিশ্বাস’ শব্দটির দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় না।

ঈমান ও বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য কী ?

ঈমান এবং ‘বিশ্বাস’ এর মধ্যে পার্থক্য দেখানোর একটি উপায় হল শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ করা। আনাস ইবনে মালিক (রা:) বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবা যা তুমি পছন্দ করো”। [সহীহ বুখারী, ইফা: ১২; ও সহীহ মুসলিম, ইফা: ৭৬]

উপরোক্ত হাদিসটি ঈমান ও বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে। এই হাদিসটিতে মুসলিদেরকে বলা হয়েছে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অপর ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করতে হবে। এটি শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কর্ম দিয়ে সম্পাদন করতে হবে। সুতরাং ঈমানও শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বাস শব্দটির সাথে কর্ম সম্পাদনের কোনো যোগসূত্র নেই। সাধারণ কথাবার্তায় কিভাবে ‘বিশ্বাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা ভেবে দেখুন। মানুষ অন্যায় মূলক কাজ করে আর বলে আমার ঈমান ঠিক আছে। এখানে বিশ্বাস উদ্দেশ্য করে থাকে।

বিশ্বাসের সাথে প্রতিশ্রুতির কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে, ঈমানের সাথে প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত। ঈমান একটি আমানত তৈরি করে । ঈমান আল্লাহর সাথে বান্দাকে অঙ্গীকারবদ্ধ করে তোলে। এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে নিজে ইসলাম শেখা, ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে অনুশীলন করা এবং অন্যকে ইসলাম শেখানো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ঈমান বৃদ্ধি পায় ও কমে :

উপমা: কুরআনের আয়াত ও হাদিসের আলোকে এটা বুঝা যায়, মানুষের ঈমান বাড়ে এবং কমে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ঈমান কিভাবে বাড়ে? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন-

প্রথম উপায়: আল্লাহর সমস্ত নাম ও গুণাবলীসহ আল্লাহ তায়ালার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। এ বিষয়ের জ্ঞান যতো বৃদ্ধি পাবে, নিঃসন্দেহে তার ঈমানও ততো বৃদ্ধি পাবে। যে সব আলেম বর্ণিত বিষয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন তারা এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন আলেমদের চেয়ে ঈমানের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী।

দ্বিতীয় উপায়: আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা এবং মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দিয়েছেন, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতো চিন্তা করবে, ততোই তার ঈমান বাড়বে।

এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, وفي الأرض آيات للموقنين وفي أنفسكم أفلا تصبرون ‘বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও। তোমরা কি অনুধাবন করবে না’ [সূরা যারিয়াত: ২০]

তৃতীয় উপায়: বেশি করে সৎ কাজ সম্পাদন করা। সৎ আমল বেশি বেশি সম্পাদনের কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায়। এমন সৎ আমল মুখের মাধ্যমে হোক, কিংবা কাজের মাধ্যমে হোক।

ঈমান কমে যাওয়ার কারণ –

ঈমান ভঙ্গের কারণ নিয়ে জানুন-
প্রথম কারণ
:
আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা এ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতো কম থাকবে, ঈমানও ততো কমতে থাকবে।
وما قدروا الله حق قدره إذ قالوا ما أنزل الله على بشر من شيء আর তারা আল্লাহকে তাঁর যথার্থ মর্যাদা দেয়নি, যখন তারা বলে, আল্লাহ্‌ কোন মানুষের উপর কিছুই নাযিল করেননি [সূরা আন‘আম : ৯১]

দ্বিতীয় কারণ: সৃষ্টি জগৎ, শরিয়ত ও আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।

তৃতীয় কারণ: গোনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। কেননা গোনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের ওপর বিরাট প্রভাব পড়ে। لا يزني الزاني حين يزني وهو مؤمن

চতুর্থ কারণ: সৎ আমল না করা ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোনো ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয়, তাহলে ঈমান কমার সঙ্গে সঙ্গে সে শাস্তির সম্মুখিন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবে- কিন্তু শাস্তির সম্মুখিন হবে না।

এই জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদেরকে জ্ঞান ও দ্বীনের ক্ষেত্রে অপূর্ণ বলেছেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাদের যখন মাসিক হয়- তখন তারা নামাজ-রোজা থেকে বিরত থাকে। অথচ মাসিক অবস্থায় নামাজ-রোজা থেকে বিরত থাকার কারণে তাদেরকে দোষারূপ করা হয় না। বরং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু পুরুষদের তুলনায় তাদের আমল কম হলো- সে হিসেবে তারা পুরুষেরে চেয়ে কম ঈমানের অধিকারী।

লেখক,
শায়েখ প্রফেসর ড. শাফী উদ্দিন আল মাদানী
সাবেক ডীন, ইসলামিক স্টাডিজ,
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights