সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

দারসুল হাদিস (এক মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ছয়টি হক ) – প্রথম পর্ব

দারসুল হাদিস

 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ

يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ

وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ

অর্থ: আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক হল ছয়টি। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে, মারা গেলে তার জানাযায় হাযির হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দিবে, যখন সাক্ষাৎ হবে তখন তাকে সালাম করবে, হাঁচি দিলে তার জওয়াবে দু’আ করবে এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত সকল সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। ( সূনান আত তিরমিজী: ২৭৩৭, মান-সহীহ)

রাবী পরিচিতি :

হাদিসের রাবী প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রা:। যিনি রাসূল সা: থেকে হাদিস বর্ণানার দিক থেকে সকলের উর্ধে। তাঁর বর্ণিত হাদিস সংখ্যা ৫৩৭৪টি।

নাম ও বংশ পরিচয়:

ইসলাম পূর্ববর্তী তার নাম ছিল আব্দু শামস (অরুণ দাস)। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল স: তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আব্দুর রহমান। এই নাম রাখার ফলে তিনি এতো বেশি খুশি হন যে তিনি রাসূল স: কে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার পিতা-মাতা আপনার নামে কুরবানী হোক। তিনি আদ দাওসী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণ:

তুফাইল ইবনে আমর আদ দাওসী রা: এর হাত ধরেই ইসলামে দীক্ষিত হন। ষষ্ঠ হিজরীতে যুবক আবু হুরায়রা রা: মদীনায় আগমন করেন এবং নিরবিচ্ছন্নভাবে রাসূল স: এর সাহচর্যে থাকেন তাঁর তেতে বিভিন্ন তারবিয়্যাত নেন। আর এর সুবাদেই তিনি হয়ে ওঠেন রাসূল স: এর সর্বাধিক হাদিস বর্ণানাকারী সাহাবী।

কুনিয়াত:

আব্দুর রহমান রা ইতিহাসে আবু হুরায়রা রা: নামেই প্রসিদ্ধ। এটি তার কুনিয়াত নাম। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি একটি বিড়াল ছানা খুঁজে পান এবং তাকে লালন পালন করেন ও তার সাথে খেলাধুলা করতেন। কখনো তিনি এটিকে নিয়ে রাসূল (স:) এরে দরবারেও উপস্থিত হতেন। আর এটা দেখে তার সাথীগণ ও রাসূল স: তাকে আবু হুরায়রা (বিড়াল শাবক ওয়ালা বা বিড়াল ছানার মালিক ) বলে ডাকতেন। আর তখন থেকে তিনি এই নামেই প্রসিদ্ধ। (আসহাবে রাসূলের জীবন কথা।)

বিড়াল ছানার পিতা নাকি বিড়াল ছানাওয়ালা: 

বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের মানুষগুলো জানেন যে, আবু হুরায়রা অর্থ  বিড়াল ছানার পিতা। শুধু তাই নয়, পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও এই অর্থটি গ্রহণ করা হয়েছে। যা একটি স্পষ্ট ভুল অর্থ। কারণ اَبٌ শব্দটি একবচন, যার বহুবচন হলো اَبُوْ (আবু) । যার অর্থ পিতা, মালিক, ওয়ালা, বিশিষ্ট, সত্বাধিকারী। পিতা অর্থ গ্রহণ করলে আবু হুরায়রা অর্থ দাড়ায় বিড়াল ছানার পিতা। কোন মানুষের পক্ষে বিড়ালের পিতা হওয়া অসম্ভব এবং তা শুনতেও বেমানান। কিন্তু যদি আবু হুরায়রা অর্থ বিড়াল ছানার মালিক, বা বিড়াল ছানা ওয়ালা নেওয়া হয়, তাহলে যথার্থ হবে। যেমন আমারা বলে থাকি মাছওয়ালা, রিক্সা ওয়ালা ইত্যাদি।  তাছাড়া বুঝার সুবিধার্থে اَبُوْ (আবু) শব্দ যোগে আরো কিছু আরবী শব্দ তুলে ধরা হলো- اَبُوْ مِلْعَقَةُ অর্থ চামচের মতো ঠোঁট বিশিষ্ট এক প্রকার পাখি। اَبُوْمِنْقَارَ অর্থ সুঁচালো লম্বা মুখ ওয়ালা এক প্রকার পাখী। اَبُوْالنَّوْمِ অর্থ আফিম গাছ। [ মুজামুল ওয়াফী ] শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করলে হবে ঘুমের পিতা। আর এই শব্দগুলোতে আবু শব্দের অর্থ বিশিষ্ট, ওয়ালা ইত্যাদি বুঝিয়েছে। সুতরাং আবু হুরায়রা অর্থ হবে বিড়াল ছানা ওয়ালা বা বিড়াল ছানার মালিক।

মায়ের ইসলাম গ্রহণ :

আবু হুরায়রা রা: যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার মা পৌত্তলিকতায় অটল ছিলেন । আবু হুরায়রা রা: তার মাকে প্রতিদিন ইসলাম গ্রহনের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু তার মা তার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় এবং রাসূল স: কে অশ্রাব্য ভাষায় গাল মন্দ করে। এতে আবু হুরায়রা রা: খুবই ব্যথিত হন এবং রাসূল স: দরবারে গিয়ে সব ঘটনা তিনি খুলে বলেন। রাসূল স: সবকিছু শুনে তার মায়ের ইসলাম গ্রহণের জন্য দুআ করেন। রাসূল স: দুআর বরকতেই আবু হুরায়রা রা: মা তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পূর্বেই শাহাদাহ পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

রাসূল স: সম্পর্কে তার মন্তব্য :

রাসূল স: কে আবু হুরায়রা রা: দু-একবার দেখে কখনো পরিতৃপ্ত হতেন না। তাই আবু হুরায়রা রা: রাসূল স: সম্পর্কে বলেন, “রাসূল স: অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর ও দীপ্তিমান কোন কিছু আমি দেখিনি। তার চেহারায় যেন সূর্যের কিরণ ঝলমল করে।”

আবু হুরায়রা রা: জন্য রাসূল স: এর দুআ:

আবু হুরায়রা রা: বলেন, একদিন আমি রাসূল স: কে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার অনেক কথাই শুনি, কিন্তু তার অনেক কথাই ভুলে যাই। একথা শুনে রাসূল স: বললেন, ‘তোমার চাদরটি মেলে ধর’। আমি মেলে ধরলাম। তারপর বললেন, ‘তোমার বুকের সাথে লেপ্টে ধর’। আমি লেপ্টে ধরলাম। এরপর থেকে আর কোন কথাই ভুলিনি।

ইমাম বুখারী  র: বলেন, আটশর মতো সাহাবী তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।

ইন্তেকাল :

অন্তিম কালে যখন তিনি রোগ শয্যায়, তখন তিনি আকুল হয়ে কাঁদছিলেন। তাকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমাদের এ দুনিয়ার জন্য আমি কাঁদছিনা। কাঁদছি দীর্ঘ ভ্রমণ ও স্বল্প পাথেয়র কথা চিন্তা করে। যে রাস্তাটি জান্নাত ও জাহান্নামে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি সেই দুই রাস্তার কোনটিতে যাব।

মারওয়ান ইবনে হিকাম রা: তাকে দেখতে এসে তার শিফার জন্য দুআ করে বললেন, আবু হুরায়রা আল্লাহ আপনাকে শিফা দান করুন। উত্তরে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার দিদারকে ভালোবাসি, আপনিও আমার দিদারকে পছন্দ করুন এবং আমার জন্য তা তাড়াতাড়ি করুন। মারওয়ান তার সাথে সাক্ষাত করে বের হতে না হতেই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হউন।

ব্যাখ্যা:

لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ

অর্থাৎ একজন মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ছয়টি অধিকার বা হক রয়েছে। আর এগুলো এমন কতগুলো অধিকার যার প্রত্যেকটি পৃথক পৃথক বিবেচনায় নিলে ইবাদতের দিক থেকে তার কোনটি সুন্নাত, কোনটি ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে, ফরজের কাতারে নয়। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন ঈমানের ভিত্তিতে নিজেকে মুমিন দাবী করে তখন তার ঈমানের দাবীই হলো অপর মুমিনের প্রতি উল্লেখিত ছয়টি কর্তব্য পালন করা। আবার এগুলো কুরআন বা হাদীস কর্তৃক নির্ধারিত নিকট আত্মীয়দের জন্য কোন অধিকার নয়, বরং এটি আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধনী-গরীব, পরিচিত-অপরিচিত সকল মুমিনের প্রতি অন্য মুমিনের ঈমানের দাবী যে, সে তার অন্য মুমিন ভাই থেকে উল্লিখিত ছয়টি অধিকার লাভ করবে। মূলত ইসলাম যেমন রক্তের বা বংশের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বারোপ করেছে ঈমানে ভিত্তিতে যে বন্ধন তৈরী হয়েছে তার ওপর।

يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ

অর্থাৎ যখন কোন মুমিন অসুস্থ হবে তখন তাকে দেখতে যাবে। একজন মুমিন অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা শুশ্রুষা করা অন্য মুমিনের নৈতিক দায়িত্ব। রাসূল (স:) অন্য একটি হাদিসে বলেন,

فُكُّوا الْعَانِيَ ـ يَعْنِي الأَسِيرَ ـ وَأَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُودُوا الْمَرِيضَ

অর্থাৎ তেমরা বন্দীকে মুক্ত কর, ক্ষুধার্তকে আহার দান কর এবং রোগীর সেবা-শুশ্রুষা কর। (সহীহ বুখারী, ইফা: ২৮৩২)

রোগীকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা করাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা স্বয়ং নিজের সেবার সাথে তুলনা করেছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে কুদসীতে এসেছে যে, রোগীর সেবা করার মাঝেই আল্লাহর সেবা, কোন অনাহারীকে আহার করানোর মাঝেই আল্লাহকে খাওয়ানো ও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে পানি করানোর মাঝেই আল্লাহকে পান করানোর সমান। অর্থাৎ সৃষ্টির সেবার মাঝেই স্রষ্টার সন্তষ্টি রয়েছে। রাসূল স: বলেছেন:

إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي ‏.‏ قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‏.‏ قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلاَنًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَهُ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِي ‏.‏ قَالَ يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‏.‏ قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلاَنٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي ‏.‏ قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ قَالَ اسْتَسْقَاكَ عَبْدِي فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي

অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিনে বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমার খোজ-খবর রাখনি। সে বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমার খোজ-খবর করব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, আর তুমি তার সেবা করনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি তার সেবা-শুশ্রুষা করলে তার কাছেই আমাকে পেতে।

হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়োছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খেতে দাওনি। সে (বান্দা) বলবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমি কি করে তোমাকে আহার করাতে পারি! তুমি তো সারা জাহানের প্রতিপালক। তিনি (আল্লাহ) বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে আহার চেয়েছিল? তুমি তাকে খেতে দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে আহার করাতে, তাহলে তা অবশ্যই আমার কাছে পেতে।

হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পানীয় চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। সে (বান্দা) বলবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমাকে পান করাব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানীয় চেয়েছিল, তুমি তাকে পান করাওনি। যদি তুমি তাকে পান করাতে, তবে তা আমার কাছে পেতে। কবি আবদুল কাদির তার “মানুষের সেবা” কবিতায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। কবির ভাষায়:

হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান

তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।

মানুষ বলিবে- তুমি প্রভু কর্তার,

আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?

বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,

তারি শুশ্রূষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।…

সুতরাং প্রতিটি মুমিনের উচিৎ রোগে শোকে অন্য মুমিনের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, তার খোজ খবর নেয়া, তাকে আর্থিক ও শারিরীকভাবে সহযোগিতা করা এবং তার সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করা।

লেখক,

হাফেজ মাওলানা নুরুল হুদা

খতিব, বাইতুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবিরহাট চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.