সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা

১.প্রশ্ন: কুরবানীর হুকুম কি?

কুরবানী করা হানাফী মাযহাব অনুযায়ী সক্ষম ব্যক্তিদের ওপর ওয়াজিব,

হাদিসে এসেছে:  من كان له سعة ولم يضحِ فلا يقربن مصلانا

“ যাকে আল্লাহ তায়ালা সামর্থ দিয়েছেন তা সত্তেও সে কুরবানী করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।

(মুসনাদ:৮২৭৩, ইবনে মাজাহ:৩১২৩)

জমহুর ফুকাহার নিকট সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আল কুরআনে এসেছে: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ

“অতএব তোমার রবের উদ্দেশ্যেই নামাজ পড় এবং কুরবানী কর”। ( সূরা আল কাউছার:২)

২.  প্রশ্ন: কুরবানী যবেহ করার সময় কখন?

দশ যিলহজ্ব ঈদের নামাজ আদায়ের পর থেকে আইয়ামে নহরের শেষ দিন অর্থাৎ হানাফী মাযহাব অনুযায়ী ১২ যিলহজ্ব পর্যন্ত।

আর জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করা চলে। তবে এক্ষেত্রে ঈদের সালাতে পর পর আদায় করাই উত্তম। হাদিসে এসেছে:

لا يَأْكُلُ يَوْمَ الأَضْحَى حَتَّى يَرْجِعَ ، فَيَأْكُلَ مِنْ أُضْحِيَّتِهِ .

“ রাসূল স: ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত কোন কিছু খেতেননা। অতপর কুরবানীর গোস্ত দিয়ে খাবার শুরু করতেন। (আহমাদ: ২২৪৭৫)

৩. কুরবানীর পশুতে কত শরীক জায়েয?

একটি মেষ, একটি ছাগল বা একটি ভেড়া অথবা একটি দুম্বা এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে শুদ্ধ হবে। তবে ছাওয়াবের ক্ষেত্রে যে কাউকে শরীক করা যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁর কুরবানী যবেহ করার ইচ্ছা করলেন, তিনি বললেন,

بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ

 “বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ, আপনি এ কুরবানী মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদের পরিবার ও উম্মতে মুহাম্মাদির পক্ষ থেকে কবুল করুন।”

( মুসলিম :৩৬৪৪)। আর গরু, মহিষ ও উটে সাত শরিক দেওয়া জায়েয।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ

হযরত জাবিন বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুদাইবিয়ার বছর এক একটি উট ও গরুতে সাতজনে শরীক হয়ে কুরবানী করেছি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩১৮, ৩০৪৮)

অন্য হাদিসে এসেছে:

عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُهِلِّينَ بِالْحَجِّ: فَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلُّ سَبْعَةٍ مِنَّا فِي بَدَنَةٍ

জাবির রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনম, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ্জের ইহরাম বেঁধে রওনা হলাম। অতঃপর তিনি উট ও গরুতে আমাদের মধ্যে সাতজন করে শরীক হবার (ও কুরবানী করার) নির্দেশ দিলেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩১৮, ৩০৪৯)

আব্বাস রা: থেকে আরো একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে,

قَالَ: كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ فَحَضَرَ النَّحْرُ، فَاشْتَرَكْنَا فِي الْبَقَرَةِ سَبْعَةً، وَفِي الْبَعِيرِ سبعة أو عشرة

তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে ছিলাম। পথিমধ্যে কুরবানীর দিন এল। তখন আমরা গরুতে সাতজন এবং উটে সাতজন বা দশজন করে শরীক হলাম। (শরীক হয়ে কুরবানী দিলাম) [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪০০৭]

জাবের রা: থেকে বর্ণিত আরো একটি হাদিস:

  ان النبي صلى الله عليه وسلم قالالبقرة عن سبعة والجزور عن سبعة

“রাসূল স:  ইরশাদ করেন, গরুতে সাত ভাগ , উটে সাত ভাগ। ( আবু দাউদ: ২৮০৮)

উল্লেখ্য যে, যদি একা কুরবানী করা যায়,তবে সেটি উত্তম।

৪. প্রশ্ন: কুরবানীর পশুর বৈধ কত হতে হবে?

জমহুর উলামাকেরাম ও ফকিহদের মতে:-ছয় মাস বয়সী ভেড়া,এক বছর বয়সী বকরী,দুই বছর বয়সী গরু,পাঁচ বছর বয়সী উট

৫. প্রশ্ন: কুরবানীর পশুর কোন কোন দোষের কারণে কুরবানী করা শুদ্ধ হবে না?

১.কুরবানীর পশু স্পষ্টত অন্ধ অথবা কানা হওয়া।

২. খোঁড়া। অর্থাৎ এমন খোঁড়া যা কুরবানীর স্থানে যেতে অক্ষম।

৩. স্পষ্টভাবে অসুস্থ পশু যে কিনা অসুস্থতার কারণে কুরবানীর স্থানে যেতে অক্ষম।

৪ একেবারে শুকনো যাতে কোনো গোশত নেই।

এর দলিল বারা ইবনে আযেব রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কুরবানীতে কানা পশু, যে স্পষ্টভাবেই কানা, লেংড়া পশু, যে স্পষ্টভাবেই লেংড়া , অসুস্থ পশু যে স্পষ্টভাবেই অসুস্থ, শুকনো পশু যাতে মজ্জা নেই, কুরবানী করা জায়েয হবে না। (মুওয়াত্তা মালেক:১০১০, তিরমিজি: ১৪১৩)

এসব দোষের সাথে, যা এসবের সদৃশ অথবা এসব থেকেও খারাপ, এ জাতীয় অন্যান্য দোষও যুক্ত হবে।

৫. কান ও লেজের অধিকাংশই কাটা হলে। হাদিসে এসেছে:

قال علي رضي الله عنه: “أمرنا  النبي صلى الله عليه وسلم: أن نستشرف العين والأذن

হযরত আলী রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল স: আমাদের (কুরবানীর পশুর) কান ও লেজ ভালোভাবে দেখে নিতে আদেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ: ২৮০৪)

৬.কোন কোন দোষ থাকলে কুরবানী করা শুদ্ধ হবে?

লেজকাটা পশু। জন্মগতভাবেই যার শিং নেই অথবা অল্পপরিমাণ শিং ভাঙ্গা। খাশী, যার অণ্ডকোষ থেকে মুষ্ক কেটে ফেলা হয়েছে। যার কান ফাটা

৭. প্রশ্ন: কুরবানীর গোস্ত বন্টনের নিয়ম কি?

উত্তর: কুরবানী গোস্ত বন্টনের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ

“ তোমাদের জবাইকৃত পশু থেকে তোমরা নিজেরা খাও ও গরীব-দুস্থদের খেতে দাও।” ( সূরা হজ্জ:২৮)

এখানে গরীব-দুস্থদের মাঝে কুরবানীর গোস্ত বিতরণ ও খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে কিন্তু  তা তিনভাগের বিষয় বলা হয়নি।

কুরবানীর গোস্ত বন্টনের ব্যাপরে ইবনে আব্বাস রা: থেকে একটি পেশ করা হয়। তা হলো: রাসূল স: কুরবানীর গোস্তের ভাগ নির্ধারণ করে দিয়ে বলেন:

يُطعِمُ أهلَ بيتِه الثُّلثَ، ويُطعِمُ فقراءَ جيرانِه الثُّلُثَ، ويَتصدَّقُ على السؤَّالِ بالثُّلثِ“

তোমরা (কুরবানীর  গোস্ত) তিনভাগের একভাগ পরিবারকে খাওয়াও, অপর তিনভাগের একভাগ নিকটস্থ গরীব প্রতিবেশীদের খাওয়াও, অপর তিনভাগের একভাগ ফকির-মিসকিনদের খাওয়াও। (কাশফুল কানায়ী: ৩/২২)। ইবনে উমরা রা: থেকে অনুরুপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

কিন্ত এই হাদিসটির হুকুম পরবর্তিতে অন্য একটি হাদিস দ্বারা রহিত হয়। যেমন রাসূল স: বলেন:

كنت نهيتكم عن لحوم الأضاحي فوق ثلاث ليتسع ذو الطول على من لا طول له فكلوا ما بدا لكم وأطعموا وادخروا

 “ আমি তোমাদেরকে কুরবানীর গোস্ত তিনদিনের বেশি রাখার ব্যাপারে নিষেধ করেছিলাম। আর তখন ছিল অত্যন্ত দুর্বিক্ষের সময়। সুতরাং এখন তোমাদের যা ইচ্ছা হয় খাও অন্যদেরও খাওয়াও এবং জমা করে রাখ। (তিরমিজি: ১৪৩০)। এই হাদিসের উপর রাসূল স: এর সময় থেকে সাহাবায়েকেরাম ও তাবেতাবেয়ীগণ আমল করেছেন। এই হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যে, গোস্ত বন্টন ও তা জমা করার ক্ষেত্রে ব্যাক্তির স্বাধীনতা রয়েছে। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (স:) অভাবী ও দূস্থদের মাঝে কুরবানীর গোস্ত বিতরে উৎসাহ দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ

“অতপর তোমরা তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়- তাদেরকে দাও। (সূরা হজ্জ:৩৬)

৮. প্রশ্ন: মুমূর্ষ জন্তু কুরবানীর নিয়ত করলে কুরবানীর দিনের আগেই কুরবানী করার হুকুম কি? কিভাবে তা আদায় করব?

কুরবানীর নির্দিষ্ট সময় হবার আগে কুরবানী করলে কুরবানী আদায় হবে না। যদি উক্ত ব্যক্তির উপর কুরবানী করা আবশ্যক হয়ে থাকে,তাহলে কুরবানীর দিন আরেকটি পশু কুরবানী করা আবশ্যক।

তবে যদি তার উপর কুরবানী করা আবশ্যক না হয়,তাহলে আর কুরবানী করতে হবে না।

মারা যাবার উপক্রম হলে পশু কুরবানীর সময় হবার আগেই পশুটি জবাই করে খাওয়া জায়েজ আছে। যদিও কুরবানীর দিন আলাদা কুরবানী আবশ্যক থেকে যায়।

جُنْدَبُ بْنُ سُفْيَانَ، قَالَ: شَهِدْتُ الْأَضْحَى مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمْ يَعْدُ أَنْ صَلَّى وَفَرَغَ مِنْ صَلَاتِهِ سَلَّمَ، فَإِذَا هُوَ يَرَى لَحْمَ أَضَاحِيَّ قَدْ ذُبِحَتْ قَبْلَ أَنْ يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ، فَقَالَ: مَنْ كَانَ ذَبَحَ أُضْحِيَّتَهُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ – أَوْ نُصَلِّيَ -، فَلْيَذْبَحْ مَكَانَهَا أُخْرَى،

হযরত জুনদুব বিন সুফিয়ান রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক কুরবানীর ঈদের নামাযে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে শরীক ছিলাম। তিনি নামায পড়ে তখনো ফিরেননি। নামায শেষ করে সালাম ফেরাতেই তিনি কুরবানীর গোশত দেখতে পেলেন। যা নামায শেষ হওয়ার আগেই জবাই করা হয়েছিল। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার নামায অথবা আমাদের নামায পড়ার আগেই কুরবানীর পশু জবাই করেছে, সে যেন তদস্থলে আরেকটি পশু  জবাই করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯৬০)

৯. প্রশ্ন: শরীকানা কুরবানীতে সম্মিলিতভাবে এক ভাগ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে দেয়া যাবে কি?

যদি প্রতিজনের জন্য আলাদা ভাগ থাকে। সপ্তামাংশ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে করে থাকে, তাহলে কুরবানী শুদ্ধ হয়ে যাবে।

উদাহরণতঃ তিনজন মিলে কুরবানী ক্রয় করা হল, এখন প্রতিজনের জন্য দুই ভাগ করে ছয় ভাগ। এবার বাকি এক ভাগ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নামে করে করে দিল।

যেহেতু প্রতিজনের জন্যই আলাদা ভাগ রয়েছে। তাই অতিরিক্ত অংশ সম্মিলিতভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে দেয়া যাবে।

১০. প্রশ্ন: দুই শরীকের একজন দুই ভাগ ও একজন এক ভাগ টাকা প্রদান করে কিন্তু গোস্ত নেওয়ায় সময় সমান ভাগ করে। এতে দজনই সন্তুষ্ট। এভাবে কুরবানী করলে কুরবানী হবে কি?

উত্তর: এতে কুরবানী হয়ে যাবে। কোন সমস্যা নেই।

১১. প্রশ্ন: কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমদের দেয়া যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ।অমুসলিমদের গোস্ত দেওয়া যাবে।

২. প্রশ্ন: কুরবানী ওয়াজিব হবার শর্ত কী? কুরবানীর ক্ষেত্রে সম্পদ হিসেবে কি পশু নির্ধারিত করা আছে?

প্রথমত: প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কুরবানীর পশু কিনার মতো সামর্থ আছে তার উপর কুরবানী আবশ্যক। যেমন হাদিসে এসেছে:

من كان له سعة ولم يضحِ فلا يقربن مصلانا

“ যাকে আল্লাহ তায়ালা সামর্থ দিয়েছেন তা সত্তেও সে কুরবানী করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।

(মুসনাদ:৮২৭৩, ইবনে মাজাহ:৩১২৩)। এই হাদিস প্রমাণ করে যে , যার কুরবানীর করার সামর্থ আছে তার উপর কুরবানী আবশ্যক।

দ্বিতীয়ত: ফকীহগণ যাকাতের সাথে কিয়াস ভিত্তিতে মত দেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

১৩. কুরবানীর গোস্ত বিক্রির হুকুম কি

না! কোনভাবেই কুরবানীর গোস্ত বিক্রি জায়েজ নেই। বরং গরু কাটা-ছিড়ার ক্ষেত্রে কসাইকেও  মজুরী হিসেবে গোস্ত দেওয়া জায়েজ নেই। হযরত আলী রা: বলেন:

عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ : أَمَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ ، وَأَنْ أَتَصَدَّقَ بِلَحْمِهَا وَجُلُودِهَا وَأَجِلَّتِهَا ، وَأَنْ لَا أُعْطِيَ الْجَزَّارَ مِنْهَا

“ হযরত আলী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম স: আমাকে তার কুরবানীর উটের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে আদেশ দেন যে, আমি যেন তার গোস্ত, চামড়া ও হাড্ডি সবকিছূ সদকা করে দেই। এবং তা থেকে যেন (কসাইকে) মজুরী না দেই। (মুসলিম:২৪০৭)

১৪. কুরবানীর চামড়া বিক্রি করা জায়েজ?

এই ব্যাপারে দুইটি মত।

প্রথমত: কোনভাবেই কুরবানী দাতার পক্ষ থেকে কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করা জায়েজ নেই। যদি এমনটি করা হয় তবে কুরবানী বাতিল হয়ে যাবে। যেমন হাদিসে এসেছে:

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : من باع جلد أضحيته فلا أضحية له

হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল স: বলেছে, যে ব্যক্তি তার কুরবানীর চামড়া বিক্রি করল তার কুরবানী হয়নি। (মুসতাদরিক হাকিম:৩৪৬৮)। এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে অনেক ফকীহগন বলেছেন নিজের কুরবানীকৃত পশুর চামড়া যদি ফকির মিসকিনকে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও বিক্রি করে তাহলেও কুরবানী হবেনা।

দ্বিতীয়ত: এই হাদিসের উপর ভিত্তি করেই ফকিহগণের আরেকটি অংশ মনে করেন যদি নিজে কোন ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে কুরবানীর চামড়া বিক্রি করে তাহলে কুরবানী বাতিল হবে। যেমন: যদি কসাইয়ের সাথে এমন চুক্তি হয় যে, পশু কাটা-ছিড়া করার মজুরীর পাশাপাশি তার নিকট চামড়া বিক্রি করতে হবে অথবা যার থেকে কুরবানীর পশু ক্রয় করা হয়েছে তার সাথে এমন কথা দেওয়া যে পশুর দাম একটু কম রাখেন,আপনার কাছেই চামড়া বিক্রি করবো, তবে কুরবানী বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া যদি কুরবানীর চামড়া গরীব মানুষের সুবিধার্থে বিক্রি করে তাদের টাকা দিয়ে দেওয়া হয় তবে তা জায়েজ। কারণ সদকার উদ্দেশ্যই হলো গরীবদের উপকার করা।

১৫. কুরবানীর সাথে আকিকা করার হুকুম কি?

কুরবানীর সাথে আকিকা করার বিষয়ে আলেমদের মাঝে দুটি মত দেখা যায়।

প্রথমত: কুরবানীর সাথে আকিকা কোন দলিল রাসূল স: ও সাহাবায়েকেরাম থেকে পাওয়া যায়নি। আর আকিকার বিষয়ের হাদিসগুলোতে একটি প্রাণের বদলে প্রাণ কুরবানী করারা কথা বলা হয়েছে। হাদিসে রাসূল ইরশাদ করেন:

كُلُّ غُلَامٍ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ، تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُحْلَقُ وَيُسَمَّى

“ প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাণের জামিনদার হলো আকিকা। তোমরা তার জন্য সাতদিনের মাথায় আকিকা করো। তার মাথার চুল কেটে দাও ও নাম রাখ। (তিরমিজি: ১৫২২)

অন্য হাদিসে রাসূল স: ছেলের জন্য দুটি ছাগল ও মেয়ের জন্য একটি ছাগল আকিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। রাসূল স: ইরশাদ করেন:

مَنْ وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَأَحَبَّ أَنْ يَنْسُكَ فَلْيَنْسُكْ، عَنِ الْغُلامِ شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ، وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ

“ যার সন্তান জন্মলাভ করেছে তার উচিৎ কুরবানী করা। সে যেন ছেলের জন্য দু্টি ও মেয়ের জন্য একটি ছাগল কুরবানী করে।” ( বুখারী:২৮৪২)

সুতরাং তাঁদের মত হলো কুরবানীর সাথে আকিকা করলে তা আদায় হবেনা। কারণ একটি ইবাদতের ভিতর অন্য একটি ইবাদত ঢুকে যায় এবং আকিকার যে উদ্দেশ্য একটি প্রাণের বদল একটিপ্রাণ কুরবানী হয়না।

দ্বিতীয়ত: তাবেয়ী ও ফকীহগনের একটি অংশ মনে করেন, আকিকা পৃথক দেওয়াই উত্তম। কিন্তু কুরবানীর সাথে আকিকা করা জায়েজ। তাদের দলিল হলো: বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবনে আবি শায়বা রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

اذا ضحى عن الغلام فقد اجازات عنه العقيقة

“ যখন কুরবানী করা হয়ে তার সাথে সন্তানের জন্য আকিকা দেওয়া জায়েজ।(মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা:৮/২৪৪)।

কিন্তু এইমতের ফুকাহাগণ জায়েজ তথা বৈধ বলেছেন উত্তম নয়।

১৬. পরিবার সদস্যের টাকা কমবেশি করে শরীকানা কুরবানী দিলে সবার কুরবানী আদায় হবে কি?

এক পরিবারের যত জনের উপর কুরবানী আবশ্যক পরিমাণ সম্পদ থাকে, সবার উপরই কুরবানী করা আবশ্যক।

পরিবারের একজন কুরবানী করার দ্বারা সবার পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় হয় না। সবারই আলাদাভাবে কুরবানীতে অংশিদার থাকতে হবে।

তবে যদি একজন কুরবানীর পশু ক্রয় করে, বাকি যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব, তাদের জানিয়ে তাদের অংশও সংশ্লিষ্ট করে নেয়, আর তা যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে অনুমতি প্রদান করে, তাহলে একজন টাকা দিলেও যাকে অন্তর্ভূক্ত করল, তার কুরবানীও আদায় হবে।

যেমন আপনাদের পিতা ও দুই ভাইয়ের প্রত্যেকের উপর যদি কুরবানী ওয়াজিব হয়, আর আপনি একা একটি গরু ক্রয় করে এক অংশ আপনার বাবার ওয়াজিব কুরবানী, আরেক অংশ আপনার ভাইয়ের ওয়াজিব কুরবানীর অংশ তাদের জানিয়ে নিয়ত করে নেন, তাহলে এর দ্বারা আপনার পিতা ও ভাইয়ের কুরবানীও উক্ত পশু কুরবানী দ্বারা আদায় হয়ে যাবে।

তেমনিভাবে একজনের ভাগের টাকা আরেকজন দান করে কুরবানীর পশু ক্রয় করলেও সবার কুরবানী আদায় হবে।

১৭. মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী দিলে উক্ত গোস্ত আত্মীয়রা খেতে পারবে কি?

উত্তর: মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী দেয়ার তিনটি সূরত রয়েছে। যথা-

১যদি মৃত ব্যক্তি তার নামে কুরবানী করার জন্য অসিয়ত করে যায়, আর উক্ত মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ত্যাজ্য সম্পদ থেকেই কুরবানী দেয়া হয়।

২ মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে গেছে তার নামে কুরবানী দেয়ার জন্য কিন্তু তার সম্পদ থেকে কুরবানী দেয়া হয়নি, বরং আত্মীয়রা নিজের সম্পদ থেকে তার নামে কুরবানী করে দিয়েছে।

৩ মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে যায়নি। আত্মীয়রা এমনিতেই মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করে।

উক্ত তিন সূরতের প্রথম সূরতে কুরবানীর গোস্ত পরিবারের জন্য খাওয়া জায়েজ নয়। বরং তা দান করে দেয়া আবশ্যক।

বাকি দুই সূরতে কুরবানীর গোস্ত আত্মীয় ও পরিবারের জন্য খেতে কোন সমস্যা নেই।

 

 

উত্তর দিয়েছেন:

হাফেজ মাওলানা নূরুল হুদা

খতিব, বায়তুল গফুর জামে মসজিদ, মাদামবিবিরহাট,চট্টগ্রাম।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights