সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

সময়মত নামাজ পড়ার গুরুত্ব

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার হুকুম সবার ওপরে বড় যিনি আমাদের মালিক, আমাদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুর মালিক। আগে আল্লাহর হুকুম পালন, এরপর অন্য সকল কাজ। মালিক-শ্রমিক ছাত্র-জনতা সকলের লেখাপড়া, কাজ কাম, মিটিং-মিছিল, সভা, সমাবেশ সব কাজের আগে নামাজ। আগে নামাজ পরে কাজ-এটাই ঈমানদারের কথা ও কাজ। আগে কাজ শেষ করে নিই পরে নামাজ পড়ব, আগে বৈঠক শেষ করে নিই পরে নামাজ পড়ে নেবো এমন কথা যারা বলে তারা নামাজের গুরুত্ব বুঝেনি। যারা দ্বীন কায়েমের আন্দোলন করে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের ওয়াক্তমত নামাজ কায়েমের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

নামাজের গুরুত্ব

ওয়াক্ত মোতাবেক নামাজ আদায় করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যারা নিজেদের জীবনে নামাজ কায়েম করতে পারে না তাদের দ্বারা দ্বীন কায়েম সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন ইসলামী আলোচনা বা বৈঠক চলে ও জামায়াতের সময় হয়ে যায় তখন জামায়াত না ধরে বলা হয় যে আমরা পরে নামাজ পড়ে নেবো- কিন্তু দেখা যায় পরে কখনো কখনো জামায়াতবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়া হয় না বরং একা একা পড়ে নেয়া এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে খুবই অন্যায়, আপত্তিকর। কারণ সময়মতো নামাজ পড়লে নামাজের অধীন থাকা হয়। সময়মতো নামাজ না পড়লে নামাজের অধীন থাকা হয় না বরং নামাজ তখন ব্যক্তির অধীনে চলে যায়। যখন ইচ্ছা তখন নামাজ পড়লে নামাজ হয় না। তাই আমাদের নামাজে গুরুত্ব দিতে হবে। 

একজন মুমিন কখনো নামাজকে নিজের অধীনে নিতে পারে না, বরং তাকেই নামাজের অধীন থাকতে হয়, নামাজের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়, নামাজের মর্যাদা অনেক উপরে। নামাজের ও কাজের মর্যাদা সমান নয়। নামাজকে সকল কাজের ওপরে রাখতে হবে, কাজকে নামাজের ওপর রাখা যাবে না। সবসময় নামাজের গুরুত্ব দিতে হবে।  আমরা খাবার জন্য বাঁচি না, বাঁচার জন্য খাই।

সময়মত নামাজ পড়ার গুরুত্ব

আর আল্লাহর কথা সবার ওপরে ? আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় (সূরা তওবা : ৪০) আমরা সবাই আল্লাহর হুকুমের অধীন। সময়মত নামাজ আদায় করা আল্লাহর হুকুম। অতএব, আমরা সবাই আল্লাহর হুকুম নামাজের অধীন। জান্নাত লাভ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পূর্বশর্ত নামাজের অধীন থাকা। যেহেতু আমরা সবাই আল্লাহর হুকুম নামাজের অধীন, তাই নামাজ আমাদের অধীন থাকার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের ইচ্ছা বা খেয়াল খুশিমত নামাজ পড়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। কাজটা সেরে নিয়ে নামাজ পড়ব, বৈঠক শেষ করে নামাজ পড়ে নেবো এমন কথা বলার অবকাশ ইসলামে নেই।

তারপর তোমরা নামাজ শেষ করার পর দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো? আর মানসিক প্রশান্তি লাভ করার পর পুরো নামাজ পড়ে নাও? মূলত নামাজ নির্ধারিত সময়ে পড়ার জন্যই মুমিনদের ওপর ফরজ করা হয়েছে? যথাযথ সময়ের মূল্য দেয়া মুমিনের অন্যতম একটি গুন (সূরা নেসা : ১০৩) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, কোন কাজটি জান্নাতের অতি নিকটবর্তী করে দেয়? তিনি বললেন, সময়মতো নামাজ পড়া। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, তারপর কোনটি? তারপর বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, তারপর কোনটা? রাসুল সাঃ বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (মুসলিম শরীফ)

আজানের সাথে সাথে নামাজের প্রস্তুতি

হে ঐ সব লোক, যারা ঈমান এনেছো, জুমার দিন যখন নামাজের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন আল্লাহর জিকরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও? এটাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে? (সূরা জুআ : ৯) এ আয়াতে জুমার আজান শুনামাত্র নামাজের জন্য তাড়াতাড়ি যেতে বলা হয়েছে। বর্তমানে গোটা পৃথিবীর প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিন পাঁচবার যে আজান দেয়া হয় সেই আজানই নামাজের জন্য ঘোষণা। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত জিনিস।

হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবু যার কী অবস্থা হবে তোমার, যখন তোমার ওপর এমন শাসনকর্তাগণ হবেন যারা নামাজের প্রতি অমনোযোগী হবে অথবা নামাজকে ওয়াক্তের পরে পড়বে? আমি বললাম এ অবস্থায় আপনার নির্দেশ কী? তিনি বললেন, নামাজকে যথাসময়ে আদায় করবে, যদি তাদেরকে পুনরায় নামাজ পড়তে দেখ তাহলে তুমিও পুনরায় পড়বে, এটা তোমার জন্য নফল হিসেবে সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম)

নামাজ কায়েম করা

এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামাজ কায়েম করবে,যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ নিষেধ করবে? আর সব বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে। আল কুরআন
যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম কাজ নামাজ চালু করা, তাই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নামাজকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

(তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো? আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে? জুমা-১০)রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন কোন মুসলমান ব্যক্তি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির আশায় নামাজ পড়ে, তখন তাহার পাপসমূহ গাছের পাতার ন্যায় ঝরে পড়ে।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুসলমানদের জন্য মেরাজ হলো নামাজ। যদি কেউ ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামাজ কামাই দেয়, তবে তাকে আশি হোকবা আগুনে জ্বলতে হবে।’

ধনী-গরিব, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো, শ্রমিক-মালিক সবাই একসঙ্গে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ আদায় করে। অনেক সময় মসজিদে পরে আসার কারণে বিত্তবান মানুষ পেছনের কাতারে জায়গা পেয়ে শ্রমিকের পায়ের কাছে সিজদা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সময়মত নামাজ আদায় করার মাধ্যমে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার শিক্ষা পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মান সাকাতা নাজা’। অর্থাৎ যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়। মসজিদে অনর্থক কথা বলা নিষেধ।

যুদ্ধের ময়দানে নামাজ পড়া

যুদ্ধের মাঠে নামাজের সময় নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যদিও সেটি এক রাকাত জরুরিভাবে। এটা বলা হয়নি যে যুদ্ধের মাঠে ব্যস্ত হয়ে আছ, পরে পড়ে নিও বরং বলা হয়েছে সময়মত নামাজ পড়ে নিতে হবে। একদল যুদ্ধ করবে বা পাহারা দেবে আর অন্য দল নামাজ আদায় করবে। এক রাকাত পড়ে তারা গিয়ে যুদ্ধ করবে আর যারা পাহারা দিচ্ছিল তারা এসে জামায়াতে দাঁড়াবে। মাসালা হলো যেখানেই থাক সময় হলেই জামায়াতবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়ে নাও। যুদ্ধের মত হইচই, মারামারি, কাটাকাটি, মৃত্যু, আহত, চিৎকার নানান কাজে ব্যস্ত থেকেও যে নামাজ পেছানো হয়নি সে নামাজকে কোনো কাজের বা বৈঠকের অসিলায় পিছিয়ে দিয়ে নামাজ পড়া কতটুকু বিবেকসম্মত বা যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখা উচিত।

হাদিসে সালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১. তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ।

২. কিয়ামতেও প্রথম হিসাব হবে নামাজ, তাই নামাজের ব্যাপারে খুব সাবধান হতে হবে।

৩. এক ব্যক্তিকে একা একা নামাজ পড়তে দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর, নামাজ পড়া হয়ে গেছে এমন লোক উঠে গিয়ে তাকে জামায়াত করতে সাহায্য করলেন।

৪. নামাজের আজান শুনে জবাব দিয়ে আজানের দোয়া বললে তার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যায়।

৫. কোন ব্যক্তিকে নিয়মিত জামায়াতে শরিক দেখতে পেলে তার মুমিন হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও।

৬. আজান শুনে নামাজের জন্য জামায়াতে শরিক না হলে তার ঘরে আগুন লাগানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিন্তু শিশুদের কথা ভেবে তা করেননি। আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শপথ করে বলেন, আমার এরূপ ইচ্ছা হয় যে, আজানের পর কাকেও ইমাম করে নামাজ আরম্ভ করার আদেশ দেই এবং আমি ঐ সব লোকের বাড়ি খুঁজে বের করি যারা নামাজের জামাতে শরিক হয়নি এবং কারও দ্বারা জ্বালানি কাঠ আনিয়ে ঐ ব্যক্তিগণ ঘরে থাকা অবস্থায় তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেই।

৭. তিনটি বিষয়ে বিলম্ব করো না –
ক) নামাজের সময় যখন হয়
খ) জানাজা যখন উপস্থিত হয়
গ) স্বামীবিহীন নারীর যখন উপযুক্ত বর পাও। (তিরমিযি)

৮. কোন আমলটি অতি উত্তম? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রথম ওয়াক্তে নামাজ পড়া (আহমদ)

৯. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উঠিয়ে নেয়া পর্যন্ত তিনি কোন নামাজকে তার শেষ ওয়াক্তে পড়েননি। (তিরমিযি)

১০. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জামাতের নামাজ একাকী নামাজ অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশি সওয়াব রাখে। (বোখারী শরীফ)

১১. নামাজ দ্বীনের খুঁটি, যে তাকে ঠিক রাখল, সে দ্বীনকে ঠিক রাখল। যে তাকে ভেঙে ফেলল, সে দ্বীনকে ভেঙে ফেলল।

জামায়াতে নামাজ পড়ার গুরুত্ব

আমাদের সকল কাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। সব সময় আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সতর্ক থাকব। যে কাজ করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন তার পেছনেই আমাদের ছুটতে হবে। হজরত ইবনে উমর রা. বলেন, নামাজের প্রথম সময় হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং শেষ সময় হচ্ছে ক্ষমা (তিরমিজি)। এ হাদিস থেকে জানা যায় যে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সচেতন তারা সব সময় নামাজের প্রথম সময় খেয়াল করে আর আজান হলেই মসজিদে জামাত ধরার জন্য চলে যায়। আর যারা গাফেল তারা পরে পড়ে নেবো বলে নামাজকে বিলম্ব করে। যেহেতু ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আসল উদ্দেশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তাই হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিশ্চিত ও মজবুত উপায় নামাজের প্রথম সময়ে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করে নিতে হবে। নামাজের ব্যাপারে কোনো ধরনের বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই।

হজরত আবু কাদাতা আনসারী (রা) বলেন, একবার আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে নামাজ পড়ছিলাম। হঠাৎ আমরা লোকজনের দৌড়দৌড়ি করে চলার শব্দ শুনতে পেলাম। নামাজ শেষ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম? তারা বলল, নামাজে শরিক হওয়ার জন্য আমরা দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে আসছিলাম। তিনি বললেন, এরূপ করবে না। যখনই নামাজে আসবে শান্তভাবে ও স্থিরচিত্তে আসবে। এভাবে ইমামের সাথে যতটা নামাজ পাওয়া যাবে পড়বে। আর যে অংশ ছুটে যাবে তা পরে পড়ে নেবে। (বুখারী, মুসলিম)

আল্লাহর আরশের ছায়া 

সাত শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা কিয়ামতের কঠিন দিনে তার আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে একদল লোক তার আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন যারা নামাজের কথা ভুলে যায় না, সব সময় নামাজের সময়ের খেয়ালে রাখেন কখন নামাজের সময় হচ্ছে। এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পরে অন্য ওয়াক্ত নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলে আল্লাহর আরশের ছায়া পাওয়া যাবে।
রান্না করার কারণে হোক, স্কুল কলেজ, অফিস আদালত মিটিং সিটিং বা শিল্প কলকারখানার যে কোনো কাজই জড়িত হোক না কেন নামাজের সময় হলেই প্রথমে জামায়াতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করে নিয়ে নামাজ শেষে আবার সেই কাজে মনোনিবেশ করা যাবে। আল কুরআনের নির্দেশ এটাই। 

জুমার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত 

জুমার আজানের পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম যে কাজটি করতেন তা ছিল খোতবা। তিনি সবসময় খোতবার পরে নামাজ পড়াতেন। হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার ফেরেশতাগণ নামাজের জন্য আগমনকারী ব্যক্তির নাম তাদের আগমনের পরম্পরা অনুসারে লেখতে থাকেন। অতঃপর ইমাম যখন খোতবার জন্য দাঁড়ান তখন তাঁর নাম লেখা বন্ধ করে দেন এবং জিকর (অর্থাৎ খোতবা) শুনতে মনোনিবেশ করেন।’ কুরআনে প্রথমে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হও।’ পরে বলা হয়েছে, ‘তারপর নামাজ শেষ হয়ে গেলে ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো।’ এ থেকে জুমার দিনের কাজের যে পরম্পরা বোঝা যায় তা হচ্ছে প্রথম আল্লাহর জিকির এবং তারপর নামাজ, তারপর আবার কাজ।

হজরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আমরা জুমার খোতবায় নবীকে সা. এ কথা বলতে শুনেছি, মানুষের জুমার নামাজ পরিত্যাগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্যথায় আল্লাহ তাদের মনের ওপর মোহর মেরে দেবেন এবং তারা গাফিল হয়ে যাবে। (মুসলিম) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেন, ‘আজ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের ওপর জুমার নামাজ ফরজ।’ তবে তিনি নারী, শিশু, ক্রীতদাস, অসুস্থ ব্যক্তি এবং মুসাফিরকে এ ফরজ পালনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

জুমার দিনের প্রস্তুতি

হজরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিন প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য গোসল করা, দাঁত পরিষ্কার করা, যে উত্তম পোশাক তার আছে তা পরিধান করা, এবং যদি সম্ভব হয় সুগন্ধি ব্যবহার করা। (বুখারী, মুসলিম) হযরত সালমান ফারসি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে মুসলমান জুমার দিনে গোসল করবে এবং সাধ্যমত নিজেকে বেশি করে পাক পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে, মাথায় তেল দেবে, ঘরে যে খোশবুই থাক না কেন ব্যবহার করবে, তারপর মসজিদে যাবে এবং দু’জন মানুষকে সরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বসবে না, তারপর আল্লাহর দেয়া সমর্থ অনুসারে নামায (নফল) পড়বে এবং ইমাম যখন খোতবা দেবেন তখন চুপ থাকবে, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার কৃত অপরাধসমূহ মাফ হয়ে যায়। (বুখারী)

তিনি নিজে জুমার দিন সংক্ষিপ্ত খোতবা দিতেন এবং নামাজও খুব দীর্ঘ করে পড়াতেন না। হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি নামায দীর্ঘ হওয়া এবং খোতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রমাণ করে সে দীনের ব্যাপারে জ্ঞানের অধিকারী। (মুসলিম)সূরা জুমায় ‘কেনা-বেচা পরিত্যাগ করো’ কথাটার অর্থ শুধু কেনাবেচাই পরিত্যাগ করা নয়, বরং নামাজের জন্য যাওয়ার চিন্তা ও ব্যবস্থা ছাড়া অন্য আর সব ব্যস্ততা পরিত্যাগ করা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কেবল কেনাবেচা পর্যন্তই সীমিত নয়, অন্যান্য সব ব্যস্ততাও এর অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু আল্লাহ তাআলা পরিষ্কারভাবে ঐ সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তাই ফিকহবিদগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, জুমার আজানের পর কেনাবেচা এবং অন্য সবরকমের কাজ কারবার হারাম।

ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করা

তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো? আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে ? জুমা-১০) একথার অর্থ এ নয় যে, জুমার নামাজ পড়ার পর ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়া বা রিজিকের অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে ওঠা জরুরি। বরং এ নির্দেশ থেকে শুধু এ কাজ করার অনুমতি বুঝায়। যেহেতু জুমার আজান শোনার পর সব কাজ কর্ম পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাই বলা হয়েছে, নামায শেষ হওয়ার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার এবং যে কাজকর্ম করতে চাও তা করার অনুমতি তোমাদের জন্য আছে এ আয়াতাংশের ঠিক পরের আয়াতাংশেই বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করো।’ নিজেদের কাজ-কর্ম ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়েও আল্লাহকে ভুলে যেও না। বরং সর্বাবস্থায় তাকে স্মরণে রাখো এবং তাঁকেই স্মরণ করতে থাকো।

অন্য কাজ এবং নামাজের গুরুত্ব

প্রায়ই দেখা যায় নামাজের সময় হয়েছে, আজান হচ্ছে অথচ মানুষ তার কাজ বন্ধ করছে না, ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে, বৈঠক চলছে, আলোচনা চলছে, খেলাধুলা চলছে, আজান শুনার পর তার জবাব ও আজানের গুরুত্বপূর্ণ দোয়াটি করা হচ্ছে না। বিশেষ করে আসর ও মাগরিবের সময় চায়ের দোকানের আড্ডা দেখলে আর মসজিদে লোকের অবস্থান দেখলে মনে হয় আমাদের দেশে মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম, অথচ আমাদের দেশে শতকরা ৮০ জন মুসলমান।

আর মহিলাদের ক্ষেত্রে তারা সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ভাবেন একেবারে রান্নার কাজ সেরে নিয়ে তারপর নামাজ পড়ে নেবেন, এভাবেই নামাজের সময় পার হয়ে যায়, আর পড়া হয় না, পড়লেও একেবারে শেষ সময়ে পড়ে। এভাবেই দিনের পর দিন নামাজ অবহেলা করে কাজা হয়ে যায়। অথচ নামাজ পড়ে নিয়ে বা রান্নার চুলা খুব আস্তে দিয়েই সময়মতো নামাজ আদায় করে নেয়া যায়। অনেকেই তা করেও থাকেন। নামাজ শেষে কাজে যোগ দেয়। তাই শ্রমিক মালিকসহ ভাই এবং বোনদেরকে আরো একটু সক্রিয় নামাজি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ঈমানের পরেই নামাজের স্থান। নামাজ হলো আল্লাহপাকের সামনে হাজির হওয়া তার ডাকে সাড়া দেয়া। ঈমান আছে কি নাই তার প্রমাণ দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘কিয়ামতের দিনে সর্বপ্রথম হিসাব নেয়া হবে নামাজের।

নামাজের গুরুত্ব দাও, যাকাত দাও

আল্লাহ তাআলা বলেন : নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও? (সূরা বাকারা : ৪৩) সুন্দর সমাজ গড়ার মাধ্যম নামায ও যাকাত প্রতি যুগে দীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। নামাজের মাধ্যমে চরিত্র গঠন ও যাকাতের মাধ্যমে সকলের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ইহুদিরা এ ব্যাপারে গাফেল হয়ে পড়েছিল। তাদের সমাজে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থাপনা প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়েও নামায ছেড়ে দিয়েছিল। আর জাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা সুদ খেতো।

জামাাতের সাথে নামাজ পড়ার আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদানে এবং তার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, অপর দিকে জামাাত বর্জন ও জামাাতের সাথে নামাজ আদায়ে অবহেলাকারীর বিরুদ্ধেও তার অবহেলার ক্ষেত্রে সতর্ককারী হাদিস এসেছে। ইসলামের কিছু ইবাদত একত্রিত ও সম্মিলিতভাবে করার বিধান রয়েছে। এ বিষয়টি ইসলামের উত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি বলা যায়। যেমন, হজপালনকারীরা হজের সময় সম্মিলিতভাবে হজ পালন করেন, বছরে দু’বার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় কোরবানি ঈদে মিলিত হন এবং প্রতিদিন পাঁচবার জামাাতের সাথে নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে একত্র হন।

ফজরের নামাজের গুরুত্ব ও জামায়াতে আদায় 

১. মনোবল দৃঢ় করতে হবে, “আমি অবশ্যই ফজরের নামাজ আদায় করবো।”
২. দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না। অনেক সময় জরুরি কাজ করতে করতে দেরি করে ফেলি আর হয়তো রাত ২টা ৩টায় ঘুমাতে যাই। এই অবস্থা হলে ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে যায়।
৩. দেরি করে না ঘুমালে ফজরের সময় উঠাটা সহজ হয়। দেরিতে ঘুমালে অনেক সময় অ্যালার্মটাও শুনতে পাই না।
৪. যদি ফজরে উঠতে পারেন তবে দেখবেন কিছু জরুরি কাজ সবার আগেই করে শেষ করতে পারছেন।
৫. প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। নামাজ আদায় করার পর খুব ঘুম পাবে। সে ক্ষেত্রে একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। আশা করা যায় এক সপ্তাহের মাঝেই ঠিক হয়ে যাবে।
৬. তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গিয়েও ঘুম না এলে একটু শারীরিক পরিশ্রম করে নিতে পারেন। দেখা গেছে, যদি একটু কঠিন পরিশ্রমের কাজ করা যায় তবে ঘুমাতে গেলেই তাড়াতাড়ি ঘুম আসে।

৭. যদি অ্যালার্ম শুনতে পান তবে ‘আর একটু ঘুমিয়ে নেই’ এই ভেবে শুয়ে থাকবেন না। কারণ আমি দেখেছি ‘আর একটু ঘুমিয়ে নেই’ করতে গিয়েই ফজর নামাজ মিস্ করে ফেলেছি।
৮. বাসার অন্য কেউ যদি নিয়মিত ফজরের নামাজ আদায় করে থাকে তবে তাকে বলতে পারেন ডেকে দেবার জন্য। এটা খুবই সহজ পদ্ধতি।
৯. বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছে এমন দেশে আপনি অযথা রাত জেগে বিদ্যুৎ অপচয় করছেন! অথচ রাত জেগে যে কাজ আপনি করছেন তা ভোরে ওঠে সূর্যের আলোতেও করতে পারতেন, যা চোখের জন্যও ভালো হতো।
১০. অযথা বিদ্যুৎ অপচয় করলে তার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিও করতে হবে।
১১. ফজরের নামাজ অন্য নামাজগুলোর মতোই ফরজ এবং তা যথাসময়ে আদায় করাটাও ফরজ।

কবরের মধ্যে তিনটি আজাব

কবরের মধ্যে তিনটি আজাব যা নামাজে অবহেলাকারীর জন্যও-
১. কবর এমন সঙ্কীর্ণ হবে যে তাহার এক পাশের হাড্ডি অপর পাশের হাড্ডির সঙ্গে মিলিত হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে।
২. কবরে দিনরাত্রি সবসময় ৯৯টি সাপ কামড় দেবে যার বিষ এত বিষাক্ত যে দুনিয়াতে তার শ্বাস ছাড়লে কিয়ামত পর্যন্ত কোন গাছ দুনিয়ায় জন্মিত না।
৩. আল্লাহ্ তার কবরে একজন আজাবের ফেরেশতা নিযুক্ত করবেন। তার হাতে লোহার মুগুর থাকবে। সে মৃত ব্যক্তিকে সবসময় লোহার মুগুর দ্বারা আঘাত করতে থাকবে যে মুগুর পাহাড়ে মারলে পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে।

পরিশেষে ভূমিকার শেষে লিখিত কথাগুলোকে আরেকবার স্মরণ করে এবং করিয়ে বিষয়টি সমাপ্ত করতে চাই। একজন মুমিন কখনো নামাজকে নিজের অধীনে নিতে পারে না, বরং তাকেই নামাজের অধীন থাকতে হয়। নামাজকে সকল কাজের ওপরে রাখতে হবে, নিজের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত কোনো কাজকে নামাজের ওপর রাখা যাবে না- আগে নামাজ পরে কাজ। নামাজের গুরুত্ব সবকিছুর উপর রাখতে হবে। 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights