সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান

মুসলমান কবে কুরআনের দিকে ফিরবে?

ইকরা মানে পড়ো। প্রভুর এ বাণী দিয়েই শুরু হয়েছিল মহাগ্রন্থ কুরআনের পাঠ। হায়! মানুষ এ গ্রন্থ পড়েছিলেন শুধু ঠোঁটে ঠোঁটে; কিন্তু এ বাণী তারা আত্মায় ধারণ করতে পারেননি। নবী সা: কুরআনের নমুনা হয়ে গোটা জীবন যাপন করে গেছেন উম্মতের সামনে। যেন তারা কুরআনের জীবনের অধিকারী হয়ে আলোকপ্রাপ্ত হন। আহলে সুফফার দল এবং সাহাবিরা তাই হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় আজ মুসলমান কুরআনহারা হয়ে ছিটকে পড়েছেন সভ্যতা থেকে। প্রযুক্তির দুনিয়া আজ মুসলমানকে যাচ্ছেতাই করে পছন্দমতো ব্যবহার করছে, ছুড়ে ফেলছে। তাও মুসলমান বুঝছেন না, হুঁশ আসছে না তাদের। হে মুসলমান, তোমরা কি ফেরবে না কুরআনের দিকে?

পবিত্র কুরআন এমন এক সময় নাজিল হয়েছে, যখন সমগ্র আরবসহ পুরো বিশ্ব অন্ধকারে ডুবে ছিল। এক আল্লাহর বিধান ভুলে হাজার খোদায় বিশ্বাসী ছিলেন মানুষ। মানুষ মানুষের গোলামি করতেন তখন। নারীরা হাটে বিক্রি হতেন। কুরআন সর্বপ্রথম ঘোষণা করল, মানুষ কখনো মানুষের গোলামি করতে পারে না। মানুষ গোলামি করবে এক আল্লাহর, যার কোনো শরিক নেই। নারীরা মায়ের জাতি, তাদের ভোগ্যপণ্যের মতো বিক্রি করা যাবে না। কুরআনের এ নয়া ডাকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন যুবকেরা। দিশেহারা হয়ে গেলেন আরবের ধর্মব্যবসায়ী নেতারা। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাবে? গোলামরা মানুষের মর্যাদা পাবেন? নারীদের সম্মান করতে হবে? না।

এ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। যে করেই হোক মুহাম্মদের আস্ফালন বন্ধ করতে হবে। মক্কার বড় কাফের নেতারা জরুরি সভা ডাকলেন। আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়বাদের উপস্থিতিতে মিটিং চলছে। একজন বলল, ‘অল্প কিছু দিন পরই হজ। হজের সময় মুহাম্মদ যেন বহিরাগতদের কাছে কুরআনের দাওয়াত পৌঁছাতে না পারে এ জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ আরেকজন বলল, ‘মুহাম্মদ যা বলছে, তা শোনামাত্রই মানুষ তার দ্বীন গ্রহণ করছে। তাই এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে, মানুষ যেন মুহাম্মদের কাছে না যায়।’ ‘তাহলে চলো আমরা ওলিদ ইবনে মুগিরার কাছে যাই। সেই আমাদের বলবে কী করতে হবে’ আরেক নেতা বলল।

ওয়ালিদ ছিল আবু জেহেলের দূরসম্পর্কের চাচা। আরবের সবচেয়ে ধনাঢ্য এবং ক্ষমতাধর কবি। ইমাম রাগবি রহ: বলেন, ওলিদ একজন অবৈধ সন্তান। তারপরও ক্ষমতা ও কাব্যপ্রতিভার কারণে মানুষ তাকে ‘কুরাইশের সৌরভ’ উপাধি দিয়েছিল মাজহারি। মক্কার নেতারা ওলিদের কাছে এসে বলল, ‘হে বয়োবৃদ্ধ-জ্ঞানবৃদ্ধ আরবের সৌরভ! আমাদের এমন কিছু কথা শিখিয়ে দিন, যাতে মানুষ যেন মুহাম্মদের দাওয়াত গ্রহণ না করে।’ ওলিদ বলল, আগে তোমরা বলো, আমি শুনব। তবে তোমাদের সবাইকে এক কথা বলতে হবে। মানুষ যেন তোমাদের বিশ্বাস করে। একজন বলল, আমরা বলব, মুহাম্মদ গণক। ওলিদ বলল, আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ গণক নয়। গণকেরা যেভাবে অস্পষ্ট কথা বলে, মুহাম্মদ তা বলে না। সে তো দৃপ্তকণ্ঠে সুস্পষ্ট কথা বলে। তাহলে আমরা বলব, মুহাম্মদ পাগল।

ওলিদ বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ পাগল নয়। তাঁর কথা কেউই পাগলের প্রলাপ বলে বিশ্বাস করবে না। আরেকজন বলল, আমরা বলব, মুহাম্মদ একজন কবি। ওলিদ বলল, আমি আরবের শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার সব রকম ছন্দ আমার জানা আছে। মুহাম্মদের কথা কখনোই কবিতা হতে পারে না। কবিরা অনেক অবাস্তব এবং অশ্লীল কথা বলে থাকে; কিন্তু মুহাম্মদের কথায় চরম বাস্তবতা এবং পবিত্রতা ছাড়া আর কিছুই দেখি না। আরেকজন বলল, আমরা কি বলব মুহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী? ওলিদ বলল, তোমরা কি মুহাম্মদকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনেছ? তোমরা তো তাঁকে আল-আমিন বলেই জানো। তাহলে আমরা বলব, মুহাম্মদ জাদুকর। ওলিদ বলল, মুহাম্মদ জাদুকরদের মতো গিঁট দেয় না, ঝাড়ফুঁকও করে না। তোমরা বরং আমাকে চিন্তা করতে দাও।

এ ঘটনার অল্প কয়েক দিন আগে ওলিদ রাসূল সা:-এর কাছে গিয়েছিলেন। রাসূল সা: তাকে সূরা মুমিনের প্রথম দু’টি আয়াত শুনিয়েছিলেন। ওলিদ কুরআন শুনে খুবই চমৎকৃত ও মুগ্ধ হন। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে এবার ওলিদ বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমি মুহাম্মদের মুখে এমন বাণী শুনেছি, যা কোনো মানুষ কিংবা জিনের বাণী নয়। সে বাণী এত হৃদয়স্পর্শী, যেন ফুল-ফল ভরা কোনো অবাক বৃক্ষ। এর শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। এ বাণী কখনো পরাভূত হবে না। এর বিজয় সুনিশ্চিত। তোমরা এর বিরুদ্ধে যে কথাই বলো না কেন, এর প্রচার-প্রসার, বিজয় রুখতে পারবে না। তোমরা বলো এটা জাদু। এটা পিতাকে পুত্রের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়। ভাইকে ভাইয়ের শত্রু বানিয়ে দেয়। মানুষকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’ আল্লাহ তায়ালা ওলিদের অন্যায় এ মতামতের জবাবে সূরা মুদ্দাসসিরের আটটি আয়াত (১৮-২৫) নাজিল করে দিলেন।

আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কাফেররা খুব ভালো করে বুঝেছিল, কুরআন নিছক কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। কুরআন একটি বৈপ্লবিক গ্রন্থ। আরবের সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র ও জীবনযাত্রার মান বদলে দেবে কুরআন। বিশ্বকে পাল্টে দেবে কুরআন। তাই তারা সর্বশক্তি দিয়ে কুরআনকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল। আফসোস! আজকের মুসলমান কুরআনকে নিছক ধর্মীয় বই মনে করে বুকে লাগায়, মুখে লাগায়, সম্মান দেখিয়ে কাপড় মুড়ে তাকে রেখে দেয়। কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

মক্কার নেতারা রাসূল সা:-কে নামাজ-রোজা করতে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন শুধু কুরআন প্রতিষ্ঠার বিপ্লব থেকে সরে আসার বিনিময়ে। রাসূল সা: তাদের এ দাবি মেনে নেননি। আজকের মুসলমানেরা বিশেষ করে আলেমগণ কুরআন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এড়িয়ে তসবির দানায়, ওয়াজের বৈঠকে ও মসজিদের কোণে বসে জান্নাত খুঁজছেন। বিশ্বাস করুন কুরআন ত্যাগ করে তসবির দানায় জান্নাত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লামা ইকবাল লিখেছেন, ‘বাঘের মাথায় আজ বিড়াল করছে খেলা, দরিয়ায় ডুবছে মুসলমানের ভেলা। আফসোস মুসলমানদের জন্য তারা শাহাদতের দরজা ছেড়ে আজ তসবির দানায় জান্নাত খুঁজে বেড়াচ্ছে!’

লেখক: মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

Verified by MonsterInsights